স্বপ্নের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা সেতু by আনোয়ার হোসেন

সব ঠিকাদার নিয়োগ হয়ে গেছে। তদারকির পরামর্শকও প্রস্তুত। এবার পদ্মায় মূল সেতু নির্মাণের পালা। কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে পদ্মার দুই পারেই। নদীর তিন স্থানে চলছে মাটি পরীক্ষা। শিগগিরই শুরু হবে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের (ভিত্তি) কাজ। ইতিমধ্যে মূল সেতুর জন্য পদ্মাপারে অনেক ভারী যন্ত্রপাতিও ভিড়েছে। অবশ্য সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ এবং পুনর্বাসনের কাজ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। তবে গত ২৬ নভেম্বর প্রকল্প এলাকায় গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মূল সেতু নির্মাণকাজেরই যে এখন অপেক্ষা।
ঢাকা থেকে মাওয়া ফেরিঘাট যাওয়ার পথে চৌরাস্তায়ই চোখে পড়ল সড়কের সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এটি পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের অংশ। বড় বড় ট্রাকে করে মাটি ফেলা হচ্ছে। সেগুলো সমান করছে এক্সকাভেটর।
চৌরাস্তা থেকে সোজা মাওয়া ফেরিঘাট। কিন্তু সেখানে লঞ্চ-স্পিডবোট-বাসে যাত্রী তোলার হাঁকডাক নেই। ঘাট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও পুবে, মাওয়া-মুন্সিগঞ্জ সড়কের পাশে শিমুলিয়ায়। কারণ, মূল সেতুর শুরুটা হবে মাওয়া ফেরিঘাট থেকে। মাওয়া আর আড়াই কিলোমিটার দূরের শিমলিয়া ঘাটের মাঝখানে কুমারভোগ গ্রামে নদীর পারে ডেরা গেড়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এটাই পদ্মা সেতুর নির্মাণসামগ্রী রাখার মাঠ (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড)। তাই এই সড়কটিও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। চায়না মেজর মূল সেতু নির্মাণ করবে।
এখানে বিশাল মাঠ ঘিরে দেয়াল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঠিকাদারের লোকজনের আবাসনসহ অন্য অবকাঠামো। ইট ভাঙার যন্ত্রের গরগর শব্দ, শ্রমিকের দৌড়ঝাঁপ, বড় বড় মিক্সচার মেশিন—এ সবই নির্দেশ করে কাজ শুরু হয়ে গেছে। বিশাল মাঠ পেরিয়ে নদীর পারে ভিড়েছে কয়েকটি বার্জ। এতে রয়েছে বড় বড় কয়েকটি ক্রেন। এগুলো দিয়েই নির্মাণ মাঠ থেকে সেতুর সরঞ্জাম ওঠানো-নামানো হচ্ছে।
মাওয়া ঘাট থেকে নদী পার হওয়ার সময় দেখা গেল, শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরেও চলছে নির্মাণকাজের তোড়জোড়। শিবচরের কাওড়াকান্দি ফেরিঘাট থেকে সামনে এগিয়ে সড়কের বাঁ পাশে গড়ে উঠেছে ঠিকাদার, পরামর্শক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য বাসস্থান। বিশাল এলাকার বিভিন্ন স্থানে পাথর-বালুর স্তূপ। প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত ভারী যানবাহন-যন্ত্র চলছে দিন-রাত।
২০০১ সালের ৪ জুলাই ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালের জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়।
অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর অর্থায়ন, নকশা প্রণয়ন ও ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে। সামনে আর কী চ্যলেঞ্জ আছে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সেতুর পাইলিংয়ের কাজটি খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ, ১১৮ মিটার ব্যাপ্তির পাইল বড় হাতুড়ি দিয়ে মাটির নিচে পাঠানো হবে। অনেক সময় মাটি ফেঁসে যেতে পারে। তখন মাটি বের করে আবার পাইল করতে হবে। এটা বেশ জটিল কাজ। তিনি আরও বলেন, নদীশাসনের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা আগামী বর্ষায় নদী এখনকার অবস্থায় থাকবে কি না, সে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া পানির নিচের মাটির ৩০ মিটার পর্যন্ত কেটে ঢাল তৈরি করতে হবে। এটা করার সময় ঢাল ধসে পড়তে পারে। যমুনা সেতু নির্মাণের সময়ও ১৫ মিটার ঢাল করতে গিয়ে ধস হয়েছিল। তখন নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
কাজের অগ্রগতি এবং কারা কোন কাজ পেয়েছে
মূল সেতুর কাজ পেয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এটির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল ২০১১ সালে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা অর্থায়ন স্থগিত করলে ঠিকাদার নিয়োগও ঝুলে যায়। সরকার দেশীয় অর্থায়নে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে প্রাকযোগ্য চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক দরপত্রে অংশ নেয়। তবে চূড়ান্ত অর্থাৎ আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয় একমাত্র চীনের মেজর ব্রিজ কোম্পানি।
একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় মেজর ব্রিজ কাজটি পায়। গত জুনে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। তবে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনের কাজেও সম্পৃক্ত মেজর ব্রিজ এবং তাদের বিরুদ্ধে সময়মতো কাজ শেষ না করার অভিযোগ আছে।
নদীশাসনের কাজ পেয়েছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ও বেলজিয়ামের জান ডি নাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও আট হাজার ৭০৭ কোটি টাকা দরপ্রস্তাব করে সিনোহাইড্রো কাজটি পায়। তাদের সঙ্গে গত নভেম্বরে পদ্মার দুই প্রান্তে প্রায় ১৩ কিলোমিটার নদীশাসন করার চুক্তি করেছে সেতু বিভাগ।
সিনোহাইড্রো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার কাজ করছে। কিন্তু সময়মতো তা শেষ করতে পারেনি। দুই প্রান্তের ১২ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মাণ এবং সার্ভিস এলাকা নির্মাণকাজ পেয়েছে আবদুল মোনেম লিমিটেড।
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজের অগ্রগতি ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৩ কোটি টাকায় মোনেম লি. কাজটি করছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০৯ কোটি টাকায় সার্ভিস এলাকার কাজও করছে। এ পর্যন্ত অগ্রগতি ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
এর বাইরে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে এক হাজার ৭০ কোটি টাকা। পুনর্বাসনের জন্য প্লট করার কথা দুই হাজার ৫৯২টি। অক্টোবর পর্যন্ত ৭৯০টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে।
পদ্মাপারের চিত্র পাল্টাচ্ছে
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামটা একদম পদ্মা নদীঘেঁষা। এই গ্রামেরই সন্তান আবুল কালাম আজাদ। সৌদি আরবপ্রবাসী কালাম এসেছেন ছয় মাসের ছুটিতে। পদ্মার পারে যেখানে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ডেরা গেড়েছে, সেখানে দিনে একবার হলেও ঢুঁ মারেন আবুল কালাম। এখানে ভিড়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের বড় বড় ক্রেনবাহী বার্জ। আজাদ সেগুলো ঘুরে দেখেন আর মুঠোফোনে গান শোনেন।
নদীর যেখানটায় বার্জ থেমেছে, ৩৫ বছর আগে আজাদদের বসতভিটা ছিল সেখানেই। নদীর ভাঙনে সরতে সরতে তাঁদের বসতবাড়ি এখন ঠেকেছে মাওয়া-লৌহজং সড়কের পাশে। আবার যখন আজাদ দেশে আসবেন, সেই ভিটেটাও থাকবে না। পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণ হয়ে গেছে তাঁদের বাড়িটি। সরকারিভাবে আজাদ ও তাঁর তিন ভাইয়ের জন্য পাঁচ শতাংশের প্লট বরাদ্দ হয়েছে।
আজাদ জানালেন, ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি সৌদিপ্রবাসী। প্রতিবারই এসে দেখেন গ্রামের কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তবে এবারের পরিবর্তনটা ব্যাপক। নির্মাণযজ্ঞ, বিদেশিদের দৌড়ঝাঁপ, বড় বড় বার্জ আর ক্রেন—দেখতে তাঁর ভালোই লাগে। বললেন, ‘উন্নয়ন হচ্ছে। তবে রাতে যখন বাড়িতে ঘুমোতে যাই, ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বসতভিটাটা এবার তাঁদের ছাড়তে হবে।’
আবুল কালাম আজাদের মতো মাওয়া ও জাজিরার পদ্মাপারের অনেক বাসিন্দাই সেতুর কাজের যজ্ঞ দেখে আপ্লুত। তবে এর মধ্যে অনেকেই নীরবে চোখও মুছছেন বসতভিটার মায়ায়।
আজাদের বর্তমান বাড়িটা ১৪ শতাংশজুড়ে। পুরোটাই পদ্মা সেতু প্রকল্পে পড়েছে। আজাদ নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলেন, ‘নদী নিয়ে গেলে তো কিছু করার ছিল না। এখন সরকার দেশের কাজে নিয়েছে।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরুতেই পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাবসম্পর্কিত সমীক্ষা করে সেতু বিভাগ। সেই অনুযায়ী পুনর্বাসনেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সামাজিক প্রভাবসম্পর্কিত সমীক্ষা অনুসারে প্রকল্পের কারণে ১৫ হাজার ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব পরিবারের জনসংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার। এর প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষক পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবে। এর প্রায় দুই হাজার পরিবারকে প্রকল্পের অধীনে সরকারি প্লট দিয়ে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিন হাজার পরিবারের অন্যত্র জমি রয়েছে কিংবা নিজে থেকে দূরে চলে যাবে। বাকি ১০ হাজার পরিবার বসতবাড়ি নয়, কৃষিজমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য কুমারভোগ এলাকার মুদি ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক দাবি করেন, তিনিসহ তাঁর আত্মীয়স্বজনের প্রায় ২১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও টাকা পাননি। সরকার বলছে, এগুলো খাসজমি। রাজ্জাকেরা মামলা করেছেন।
মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, এ ধরনের অনেক মামলা হয়েছে। সেগুলো বিচারাধীন।
পরিবেশগত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের কারণে দুই লাখ ৯৫ হাজার ৭২টি বড় গাছ কাটা পড়বে। এর বাইরে বাঁশ আর কলাগাছ কাটা পড়বে চার লাখ ৮৫ হাজার। তবে পরিবেশের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রকল্প এলাকায় চার লাখের বেশি গাছ লাগানোর কথা আছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাত লাখ বাঁশ ও কলার চারা বিতরণ করার কথা।
প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের কারণে প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার টন নানা শস্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। ৭৬৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা বন্ধ হবে। মাছের চাষ হয় এমন ১২ হেক্টর পরিমাণ পুকুর ভরাট করতে হবে। নদী থেকে প্রায় পাঁচ কোটি ঘনমিটার মাটি ড্রেজিং করে তোলা হবে।
জমির দর বাড়ছে
লৌহজং এলাকায় জমি বিক্রি হয় কানি বা শতাংশ হিসেবে। ১৪০ শতাংশে এক কানি। লৌহজংয়ের নদীপারের বাসিন্দারা জানান, এক যুগ আগে এই অঞ্চলে এক কানি জমির দাম ছিল এক লাখ টাকা। এখন প্রতি শতাংশ জমির দাম ঠেকেছে তিন থেকে চার লাখ টাকায়। তাও বিক্রি করার মানুষ নেই।
পদ্মা সেতুর অপর পার পড়েছে শরীয়তপুরের জাজিরায়। এর টোল প্লাজা ও সংযোগ সড়ক গেছে মাদারীপুরের নদীঘেঁষা উপজেলা শিবচর দিয়ে। সেতুর ভায়াডাক্ট, সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এলাকা ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প—সব মিলিয়ে নদীপারের প্রায় সব জমিই অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। বাকি যেসব জমি আছে, সেগুলো আর কেউ বিক্রি করছে না।
শিবচর ফেরিঘাট থেকে মহাসড়কের পাশঘেঁষে রেললাইন হওয়ার কথা। সেখানকার জমি চিহ্নিত করে খুঁটিও বসিয়েছে রেলের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরপরই বাড়তে শুরু করেছে সেখানকার জমির দর।
আড়িয়ালখাঁ সেতুর পাশের বাচামারা গ্রামের ওপর দিয়ে ২০০১ সালের দিকে শিবচর-টেকেরহাট মহাসড়ক নির্মাণ হয়। এর আগে সেখানকার বিঘাপ্রতি জমির দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। রেললাইনের জন্য মাপজোক করার আগে বিঘার দাম ছিল ২০ লাখ টাকা। সে দাম এখন ৫০-৬০ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
বাচামারা গ্রামের জমির পরিমাপক (আমিন) আবুল কালাম বলেন, মহাসড়ক নির্মাণের সময় তাঁর নিজের জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তখন বিঘাপ্রতি ৩২ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। এরপরই জমির দর বাড়তে থাকে। এবার রেলের কথা শোনার পর জমির বেচাই বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রকল্প ঘিরে ব্যবসা-চাকরির হাতছানি
প্রকল্প এলাকা এবং প্রকল্পের প্রধান কার্যালয় বনানীর সেতু ভবনে প্রতিদিনই ব্যবসায়ী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা নানা তদবির নিয়ে হানা দিচ্ছেন। চাকরি দেওয়ার নাম করে একাধিক প্রতারক চক্রও সক্রিয়।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকা ডিপোজিট করার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে একাধিক ব্যাংক চিঠি দিয়েছে। সম্প্রতি দুটি বেসরকারি ব্যাংক এ ধরনের চিঠি দেয়। বাংলাদেশে থাকা দেশি-বিদেশি প্রায় সব সিমেন্ট কোম্পানিই তাদের পণ্যের গুণগত মান তুলে ধরে তা ব্যবহারের জন্য আবেদন জানিয়েছে। রড-লোহার কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রতিদিনই প্রকল্পের পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের কক্ষে ধরনা দিতে দেখা গেছে। আছেন পাথর, বালু ও বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্যের কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরাও।
প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেকে দেখা করতে চান। কিন্তু নির্মাণকাজে কী পণ্য ব্যবহার হবে, তা ঠিক করার ক্ষমতা প্রকল্প কর্মকর্তাদের নেই। এটা ঠিকাদারের এখতিয়ার। আর তা তদারকির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে।
গত ২৮ নভেম্বর লৌহজংয়ে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন চাকরির জন্য এসেছেন। তাঁদের একজন শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি সার্ভেয়ার হিসেবে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে মংলা বন্দরে অন্য একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর অধীনে সার্ভেয়ার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পটি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। চাকরিও করা যাবে অনেক দিন। থাকার ব্যবস্থা পেলে কম বেতনেও রাজি হয়ে যাবেন।
ক্রেন অপারেটরের চাকরির জন্য এসেছিলেন আবুল কাশেম। তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করেছেন।
প্রকল্পে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সম্পর্কিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রকল্প চলাকালীন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এর বাইরে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এর টোল প্লাজা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে স্থায়ীভাবে আরও অনেক কর্মসংস্থান হবে। এসব কজে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
চাকরির এই সুযোগ তৈরির ফলে প্রতারক চক্রও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শিকদার ট্রেডিং কোম্পানি নামে একটি প্রতিষ্ঠান জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারণা শুরু করে। প্রতারক চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার এবং ৯৮ জন শ্রমিককে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে এর আগেই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে জামানত বাবদ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
পিছিয়ে আছে রেললাইন নির্মাণ, পথ নিয়েও ক্ষোভ
মূল সেতুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে না রেলপথ নির্মাণের কাজ। প্রাথমিকভাবে মাওয়া থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এখনো অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাপানি অর্থায়ন ধরে নিয়ে রেলের কর্মকর্তাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে যশোর পর্যন্ত প্রায় ১৬০ কিলোমটার রেলপথ নির্মাণের কথা রয়েছে। একটি অংশ গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার, বাকিটা যশোর পর্যন্ত ৭৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইন নির্মাণে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি এখনো পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়নি। একাধিক নদী থাকার কারণে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে মুন্সিগঞ্জ জেলার সীমানা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার উড়ালপথে রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা তিনটি পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্যের চেয়েও বেশি। জটিল কাজ বলে এই অংশটুকু পরে করা হবে।
দ্বিতীয় ভাগ বা ভাঙ্গা-যশোর অংশের রেললাইন নির্মাণ নির্ভর করবে পরবর্তী অর্থায়ন পাওয়ার ওপর।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে রেললাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা প্রণয়ন ও দরপত্র দলিল তৈরির লক্ষ্যে কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যানারেলের নেতৃত্বে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাদের ২০১২ সালে প্রায় ২৩৭ কোটি টাকায় নিয়োগ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত রেললাইন করতে হলে ৩৬৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে ২৭৩ হেক্টর ব্যক্তিগত ও ৯২ হেক্টর সরকারি জমি। ইতিমধ্যে কয়েকটি এলাকার মানুষ প্রতিবাদ জানিয়ে নকশা পরিবর্তনের আবেদন করেছেন। সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ এসেছে মুন্সিগঞ্জের নিমতলা বাজার, শিবচরের বাচামারা গ্রাম ও পুলিয়া বাজারের বাসিন্দাদের কাছ থেকে। কারণ, রেলপথটি এই তিন স্থানের মাঝখান দিয়ে যাবে। প্রায় ৮০টি বাড়ি নিয়ে বাচামারা গ্রামের পুরোটাই সরিয়ে ফেলতে হবে।
সম্প্রতি বাচামারা গ্রামে গেলে বাসিন্দারা বলেন, নদীর পূর্ব পারে যেখানে সীমানা দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে সোজা রেললাইন গেলে বাড়িঘর ভাঙা পড়ে না। জমির ওপর দিয়ে চলে যায়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণ কমানোর জন্য মহাসড়কের পাশ দিয়ে, বসতির ওপর দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করেছে।
বাচামারা গ্রামের বাসিন্দা আলাউদিন মৃধা ও রাজ্জাক মৃধা বলেন, এপার-ওপার করে সাতবার বসতবাড়ি নদীতে গেছে। রেললাইনের কারণে অষ্টমবার ভাঙতে হবে। কিন্তু এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের বসতবাড়ির বাইরে আর কোনো জমি নেই। ফলে অনেক দূরে বা অন্য জেলায় চলে যেতে হবে তাঁদের। এর আগে মহাসড়ক নির্মাণের সময় গ্রামের মানুষ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রেললাইন চাই। তবে আরও ১০০ গজ দক্ষিণে রেললাইন হলে সোজা পথে হয় এবং আমরাও বেঁচে যাই। রেলপথ বাঁকা করেই আমাদের সর্বনাশ করা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক সাগর কৃঞ্চ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, সেতু চালুর দিন থেকেই রেল চালুর লক্ষ্যে কাজ এগোচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে তিনি বলেন, সবচেয়ে কম মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই বিবেচনা শুরু থেকেই ছিল। এর পরও কিছু করার থাকলে দেখা হবে।
জীবন বদলের স্বপ্নে বিভোর দক্ষিণের মানুষ
গত ২৭ নভেম্বরের কথা। নতুন শিমুলিয়া ঘাট থেকে কাওড়াকান্দি যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। ফেরিতে কথা হলো খুলনার বাসিন্দা কাপড় ব্যবসায়ী দুলাল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। ঢাকায় আসেন নিয়মিত। মাওয়া-কাওড়াকান্দি হয়ে খুলনা যেতে দিনের বেলায় লাগে সাত ঘণ্টা আর রাতে হলে সেটা ১০ ঘণ্টায় গিয়ে ঠেকে। এর মধ্যে পদ্মাপারে নেমে নৌযানে ওঠা, নদী পাড়ি দিয়ে আবার গাড়িতে উঠতেই তাঁর তিন ঘণ্টা লেগে যায়। অথচ পদ্মা সেতু হলে ট্রেন বা বাস যে যানেই হোক নদী পাড়ি দিতে ২০-৩০ মিনিটের বেশি লাগবে না।
আনন্দে হাসি না চেপেই দুলাল বলেন, কবে যে সেতু হবে আর পাড়ি দেব, তর সইছে না। আসলে দক্ষিণের মানুষের যে এখন কী কষ্ট তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বোঝতে পারবে না। পদ্মা সেতু দক্ষিণের মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়েই দেখা দেবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা বলছে, সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার মানুষের জীবন পাল্টে যাবে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বেড়ে যাবে ১ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
এই সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পার সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুরে একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্যে জমির স্কেচম্যাপ করা হয়েছে। দক্ষিণ পারে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পদ্মা সেতুর দুই পারে সেনাবাহিনীর একটি কম্পোজিট ব্রিগেড করার জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতু ঘিরে এ এলাকায় কর্মযজ্ঞ কেবল শুরু বলা যায়।

No comments

Powered by Blogger.