এই বোঝা কি বহনযোগ্য? by ড. আর এম দেবনাথ

দ্রব্যমূল্য বা মূল্যস্ফীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ২০১৪ সালটি ছিল শান্তি ও স্বস্তির। বহুদিন পর মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে নেমেছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি এখন মূল্যস্ফীতি। এ কথা জানা, আমাদের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি-হ্রাসের বড় উপাদান আমদানিজাত দ্রব্যের মূল্য। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের, পেট্রোলিয়াম, ডিজেল ও কেরোসিনের। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। বস্তুত এই কয়েকটির মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতিকে তছনছ করে দিতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হয় ২০১৫ সালটি সুখের হবে না। স্বস্তি তো নয়ই। কারণ সরকার আগাম জানান দিয়ে যাচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হবে। অবশ্য এখন বৃদ্ধির কথা বলা হয় না, বলা হয় সমন্বয়ের কথা, অ্যাডজাস্টমেন্টের কথা। এই সমন্বয়েরই একটা খবর পড়লাম গত শনিবারে। খবরটিতে বলা হয়েছে : ডিজেলে ভর্তুকি তুলে নেয়ার প্রস্তাব কৃষি খাতে অব্যাহত থাকবে। প্রস্তাবটি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। ডিজেল বাদে অন্যান্য জ্বালানির খবরও আছে। তাতে বলা হয়েছে কেরোসিন বাদে অন্যান্য জ্বালানি তেলের বিপরীতে প্রদত্ত ভর্তুকি বাতিলের প্রস্তাবও করেছে বিপিসি। এদিকে কিছুদিন আগের খবর আছে গ্যাসের। ওই খবরে বলা হয়েছে সব ধরনের গ্যাসের দাম বাড়বে। এখন এক চুলার জন্য দিতে হয় ৪০০ টাকা। বাড়িয়ে করা হবে ৮৫০ টাকা। দুই চুলায় লাগে ৪৫০ টাকা। বেড়ে হবে ১০০০ টাকা। গৃহস্থালির গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে সিএনজির দাম। এর পরিমাণ হতে পারে তেত্রিশ শতাংশ। বাকি রইল ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য। বলাবাহুল্য, এর দামও যথারীতি বাড়বে। খবরে দেখলাম বর্তমানে এক হাজার ঘনফুট গ্যাসের মূল্য যেখানে মাত্র ১১৮ টাকা, সেখানে তা বেড়ে হবে ২৪০ টাকা। সিএনজির মূল্য প্রতি হাজার ঘনফুটের জন্য ৮৪৯ টাকার স্থলে হবে এক হাজার ১৩২ টাকা। শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও বাড়বে যথারীতি। এর মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ উল্লেখ করলাম না। বাকি রইল বিদ্যুৎ। মাস দুয়েক আগেই পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। তাদের প্রস্তাব কার্যকর হলে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য ইউনিট প্রতি চার টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে হবে ৫ টাকা ৫১ পয়সা।
জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির এত বড় ফিরিস্তি ওপরে তুলে ধরার কারণ নিশ্চয়ই বোধগম্য। সবাইকে বোঝানো এর ব্যাপকতাটা কত বেশি। দেখা যাবে মূল্যবৃদ্ধির হার হবে কমপক্ষে ৩০-৩৫ শতাংশ থেকে ১০০-১২৫ শতাংশ পর্যন্ত। এবং তা হবে নববর্ষে সরকারের উপহার। উপহার কাকে? যদি গ্যাসের চুলার কথা দিয়ে শুরু করি তাহলে এই উপহার পাবে শহরের মধ্যবিত্ত, নিুমধ্যবিত্ত। এতে পড়বে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন শহর, উপশহরের বাসিন্দারা। এবং মূল্যবৃদ্ধির এই উপহার বা বোঝাটা বেশ বড়। দুই চুলায় ৪৫০ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা। মধ্যবিত্ত ও নিুমধ্যবিত্তের জীবন এমনিতেই অতিষ্ঠ। তাদের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের জীবনধারণের ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। আয়ের প্রশ্নে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্তের, নিুবিত্তের আয় বরং হ্রাস পেয়েছে। যারা ব্যাংকের সুদে সংসার চালান তাদের উদাহরণ এই স্থলে দেয়া যায়। দ্বিতীয় কথা, বাড়াতে যদি হয়ই, এই হারে কেন? সহ্যসীমার মধ্যে বৃদ্ধি করতে সরকারের বাধা কোথায়? বড় বড় কথা বলতে বলতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাথায় মনে হয় বড় বড় বৃদ্ধির বিষয়টি ঢুকে পড়েছে।
পরে আসে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা। সর্বনাশে কিঞ্চিৎ রক্ষা। খবরে দেখা যাচ্ছে সরকার কৃষি খাতে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম বাড়াবে না অর্থাৎ এর ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষিতে কতটুকু ডিজেল ব্যবহৃত হয়। খবর থেকে জানা যায়, সর্বমোট ৩২-৩৩ লাখ টন ডিজেলের মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ ডিজেল ব্যবহৃত হয় যোগাযোগ খাতে। এর মধ্যে বাস, ট্রাক, লরি, লঞ্চ ও স্টিমার ইত্যাদি নিশ্চয়ই পড়ে। তাহলে কী দাঁড়াবে অবস্থা? পরিষ্কার বোঝা যায় ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পুরো বোঝাটা পরিবহন মালিকরা চাপিয়ে দেবে সাধারণ যাত্রীদের ওপর। শুধু যাত্রী পরিবহনের মূল্য বাড়বে না, বাড়বে পণ্য পরিবহনের মূল্যও। তার মানে একটাই। মূল্যস্ফীতির ওপর আবার চাপ বৃদ্ধি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক কঠোর নিয়ম-নীতি ও নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করে মূল্যস্ফীতির হারকে দুই বছরের মধ্যে সর্বনিু পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। আমি নিশ্চিত ডিজেলের প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতির হার আবার বাড়বে যা নিয়ন্ত্রণ করা এক কঠিন কাজ হবে।
ডিজেলের কেন, সব জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা যুক্তিই দেয়া হয়। আমদানিকৃত জ্বালানির দাম বেশি, বিক্রয়মূল্য কম। অতএব দিতে হচ্ছে ভর্তুকি। এর পরিমাণ বিশাল। এতে বাজেটের ওপর চাপ পড়ে। বাজেট ঘাটতি বাড়ে। বাড়লেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধরনের প্রতিষ্ঠান এসে হাজির হয়। বলে, খবরদার। তোমরা ভর্তুকি দিতে পারবে না। মেনে নিলাম এই যুক্তি তর্কের খাতিরে। কিন্তু গোল বাধে অন্যত্র। এখন তো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে না। বরং কমছে অনেকদিন থেকে। এই পড়তি দামের সুবিধা সরকার ভোক্তাদের দেয়নি। ঠিক যেন ব্যবসায়ীর আচরণ। ব্যবসায়ীরাও আন্তর্জাতিক বাজারে মালের দাম কমলে ক্রেতাদের তার সুবিধা দেয় না। কিন্তু বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে তারা তার বোঝা ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেন। দৃশ্যত সরকার তাই করল। বরং উল্টো এখন দাম বাড়াতে চাইছে। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশেই ক্রমনিুমুখী জ্বালানি তেলের মূল্যের সুবিধা ভোক্তারা পাচ্ছে। আমরাই পেলাম না।
সুখবর, কেরোসিনের মূল্য সরকার বাড়াবে না। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন কেরোসিন ব্যবহৃত হয় কতটুকু? বিদ্যুতের সুবিধা সম্প্রসারণ, সোলার বিদ্যুৎ ইত্যাদির কারণে কেরোসিনের ব্যবহার সীমিত। তবু গরিবের কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এবং কৃষিতে ব্যবহৃত ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্তের জন্য সরকারকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ এ দুটোর দাম বাড়ালেও আমাদের করার কিছু ছিল না। কোনো প্রতিবাদ নেই। খালি নির্বাচনের কথা, গদিতে বসার কথা। সাধারণের স্বার্থে প্রতিবাদ কোথায়? কোথায় প্রতিবাদ শিল্পায়নে বিঘ্ন সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে। শিল্প খাত এমনিতেই বিপদগ্রস্ত। স্টিল মিল, শিপ বিল্ডিং, শিপব্রেকিং, সুগার মিল, টেক্সটাইল মিল, আবাসন শিল্প, ব্রিকফিল্ড থেকে শুরু করে নানা শিল্প নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের ব্যাংক ঋণের সমস্যা। সুদের হার কমেই না। ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত হারে কমানো হয়েছে। এর ছটাক সুবিধাও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের দেয়নি। সুদের ওপর তস্যসুদ। কমিশন, চার্জ, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর, শুল্ককর ইত্যাদির বর্ধমান বোঝা শিল্পের ওপর ইতিমধ্যে চাপানো আছে। এখন নতুন করে আসছে আরেক চাপ। বিদ্যুতের দাম বাড়বে, গ্যাসের দাম বাড়বে। যেসব বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা গ্যাস দিয়ে নিজেরা বিদ্যুৎ তৈরি করে (ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ), তাদের গ্যাসের দাম বাড়বে। আবার যারা লাইনের মাধ্যমে শিল্পকারখানায় গ্যাস নেবেন বা নিয়েছেন, গ্যাস ব্যবহার করছেন তাদের গ্যাসের মূল্যও বাড়বে। এবং বাড়ার হার যথেষ্ট। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াল? বাজারের খবর, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান বর্তমান ক্যাশ ফ্লো ঠিক রাখতে পারছে না। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে না। অনেকেই ঋণখেলাপি হচ্ছেন, অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। অনেকে ঋণ পুনঃতফসিল করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেক ব্যবসায়ী ঋণের কাঠামোগত পরিবর্তন করছেন। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত বোঝা তারা কীভাবে বহন করবে? বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে সম্ভাব্য রোগী ব্যবসার জন্য একটা স্পেশাল সেল খুলেছে। উদ্দেশ্য এদের সমস্যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা। এই সময়েই নতুন বছরের খবর হল বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়বে শিল্পের ক্ষেত্রেও।
মধ্যবিত্তের জন্য খারাপ খবর মোটামুটি তিনটি। সিএনজির মূল্য বাড়বে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়বে। আবাসিক গ্যাসের মূল্য বাড়বে। জাপানের একটা খবর পড়েছিলাম। লোকের গাড়ি আছে, তেলের দামের জন্য তারা গাড়ি ব্যবহার করতে পারে না। ফ্রিজ আছে, এয়ার কন্ডিশনার আছে কিন্তু বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের কারণে তারা তা ব্যবহার করতে পারে না। আমরা সদ্য উন্নতির পথ ধরলাম। অথচ এখনই কি গাড়িটি বাড়িতে রেখে হেঁটে পথ চলব? এখনই কি চেয়ে চেয়ে ফ্রিজ ও এয়ারকন্ডিশনার দেখব অথচ তা ব্যবহার করতে পারব না? মনে হচ্ছে উন্নতি করতে করতে শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত এই জায়গাতেই যাবে। না গেলে খুবই খুশি। তবু যদি দেশের শিল্পায়নটা হতো খুশি হতাম। কিন্তু তাতেও দেখা যাচ্ছে শতমুখী বাধা। ব্যবসায়ীরা কত অভিযোগ করে যাচ্ছেন। তার কতটুকু নিরাময় হচ্ছে- তার খবর কে রাখে? মূল সমস্যা রাজস্বের। সরকারের রাজস্ব নেই, পর্যাপ্ত রাজস্ব নেই। এডিপির প্রায় পুরোটাই ঋণের টাকা- বৈদেশিক ও দেশী। কেউ কর দিতে চায় না। যারা একবার করের জালে ঢুকেছে তাদের নিংড়ে নিংড়ে রস বের করা হয়। অথচ বড় বড় কোম্পানি আয়কর ফাঁকি দেয়, শুল্ক ফাঁকি দেয়, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ মামলায় আটকা, হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব মামলায় আটকা। যদি রাজস্ব বাড়ানো যেত, যদি অপচয়, চুরি বন্ধ করা যেত, যদি এক টাকার কাজ এক টাকায় করা যেত তাহলে যে ভর্তুকির কথা বলে শিল্পমালিকদের, মধ্যবিত্তদের বোঝা বাড়ানো হচ্ছে তা করতে হতো না। শেষ কথা, আমি মূল্যবৃদ্ধির সম্পূর্ণ বিরোধী নই। কিন্তু ৪৫০ টাকার জিনিস এক লাফে ১০০০ টাকা হবে তা কোনো যুক্তিতেই মানা যায় না। আরও কথা আছে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আছে। একে মারাত্মকভাবে উস্কে দিতে পারে এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরকার বিরত থাকলে ভালো হবে। যৌক্তিক করতে গিয়ে আইএমএফ-এর ক্রীড়নক হলে চলবে না।
ড. আরএম দেবনাথ : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.