পাখির প্রতি বিরল ভালবাসা

লালবাগ থানার আমলিগোলা এলাকার একটি বাসার ছাদে পাওয়া যায় দুর্লভ প্রজাতির একটি গ্রিন উইংস ম্যাকাও পাখি। পাখিটির দাবিদার প্রায় শ’ খানেক ব্যক্তি। প্রথমে বাকবিতণ্ডা, হাতাহাতি, মারামারি। দ্বন্দ্ব চরমে। উৎসুক জনতার ভিড়। রাস্তাঘাটে চরম যানজট। দুই মহল্লার মধ্যে পাখি দখলে রাখার প্রতিযোগিতা। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন লালবাগ থানার একদল পুলিশ। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষমেশ লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুল মোত্তাকিন নিজের জিম্মায় নিয়ে আসেন পাখিটি। শেষে পাখিটির ঠাঁই হলো লালবাগ থানার নিরাপত্তা হেফাজতে। ঘটনাটি গত শুক্রবারের। খবর পেয়ে কলাবাগান থানার পুলিশ নিয়ে লালবাগ থানায় যান বিশিষ্ট পাখি বিশেষজ্ঞ ড. ওয়াদুদ। উল্লেখ্য, গত বুধবার তার এই ম্যাকাও পাখিটি হাতিরপুলের মিনি চিড়িয়াখানার খাঁচা থেকে উড়ে যায়। পাখিটিকে খেতে দেয়ার  সময় ভুলবশত খাঁচার দরজা বন্ধ না করায় পাখিটি পালিয়ে যায়। এ ব্যাপারে কলাবাগান থানায় ড. ওয়াদুদের একটি জিডি করা আছে। হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোড ও আশেপাশের এলাকায় মাইকিং ও পোস্টারিং করা হয়। ২০১১ সালে পাখি মেলা উপলক্ষে এক জোড়া গ্রিন উইংস ম্যাকাও পাখি সুদূর বলিভিয়া থেকে ১২৫০০ ডলার দিয়ে নিয়ে আসেন ড. আবদুল ওয়াদুদ। ওই মেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আ. আ. ম. স. আরেফিন সিদ্দিকি ও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। ২২/২, হাতিরপুলে অবস্থিত ফিকামলি সেন্টারের মিনি চিড়িয়াখানা প্রাঙ্গণে পাখিমেলায় তারাসহ অনেকেই এই পাখিটি দেখেছেন। পাখির ডি.এন.এ’র টেস্ট রিপোর্টও রয়েছে। পাখির উপযুক্ত কাগজপত্র, দলিলাদি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে লালবাগ থানা সন্তুষ্ট হয়। নিশ্চিত হয়ে থানার ওসি ড. ওয়াদুদকে পাখিটি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে বিষয়টি অবহিত করে পাখিটি দিয়ে দেন। এরই মধ্যে খবর পেয়ে আরেক দাবিদার লালবাগ থানায় প্রতিনিধি পাঠান। তিনি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। তার দাবি, পাখিটির বৈধ মালিক তিনি। ক্যাপ্টেন সামিউর রশিদের নেতৃত্বে পাখি উদ্ধারে ড. ওয়াদুদের বাড়িতে বিজিবি’র একদল জওয়ানকে পাঠিয়ে দেন মহাপরিচালক। কিন্তু ড. ওয়াদুদ তার প্রমাণে অটল, এ পাখি তার। প্রয়োজনে কোর্টে যাওয়ার পরামর্শ দেন বিজিবি মহাপরিচালককে।
বিজিবি মহাপরিচালকও পাখির জন্য অধীর অপেক্ষায়। তিনি ড. ওয়াদুদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। পাখি পাওয়ার জন্য তার আগ্রহ, আকুলতা ও পাখির প্রতি ভালবাসা দেখে মন বদলালেন ড. ওয়াদুদ। উদার মনের পরিচয় দিয়ে গত শনিবার উপহার হিসেবেই বিজিবি মহাপরিচালককে দিয়ে দিলেন পাখিটি। মিটে গেল বিবাদ। বিকালে ড. ওয়াদুদের হাত থেকে উপহার হিসেবে পাখিটি গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের পক্ষে ক্যাপ্টেন সামিউর রশীদ। কয়েকদিন আগে বিজিবি সদর দপ্তর পিলখানা থেকে আজিজ আহমেদের এক জোড়া গ্রিন উইংস ম্যাকাও পাখি উড়ে যায়। তখন থেকেই তিনি পাখির খোঁজ করতে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়।
পাখি উপহার দেয়া প্রসঙ্গে ড. ওয়াদুদ জানান, খাঁচা থেকে উড়ে গিয়ে পাখিটিকে অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে। ঠিকমতো খাবার না পেয়ে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে। পাখিটি যখন ধরা পড়ে তখন সে ছিল ক্ষুধার্ত, বিপর্যস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত। আবার মালিকানা নিয়ে থানা পুলিশ আদালতে গেলে পাখিটির কষ্ট হবে। সর্বোপরি বিজিবি প্রধানের পাখির প্রতি ভালবাসা ও মমত্ববোধ দেখে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত। এছাড়া পিলখানায় পাখিটি পালনের উপযুক্ত পরিবেশও রয়েছে, তাই পাখিটি তাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিই। এটা আমার কাছে এমন নতুন কিছু নয়। অনুকূল পরিবেশ থাকলে প্রকৃত পাখি প্রেমিকদের মাঝে মধ্যে আমি পাখি উপহার দিয়ে থাকি। আমার কাছে বিশটির মতো ম্যাকাও রয়েছে। কোন কোন ম্যাকাও নিয়মিত বাচ্চাও দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে প্রিন্স ও প্রিন্সেস নামের একজোড়া ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও পাখির সংসার ভাঙা নিয়ে ঢাকার আদালতে আইনি লড়াই চালিয়ে যান ড. ওয়াদুদ। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাখি দুটিকে আর একত্র করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা থেকে নতুন পুরুষ পাখি এনে সংসার গড়ে দেয়া হয়েছে প্রিন্সেসের। প্রিন্সেস ও আলেকজান্ডারের সুখের সংসারে গত সেপ্টেম্বরে বাচ্চা এসেছে। ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও পাখি প্রিন্সেসকে কেন উপহার হিসেবে দেয়া হলো না জানতে চাইতে ড. ওয়াদুদ জানান, প্রিন্সেসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ছিল না, তাই দেয়া হয়নি। আমি পাখি দু’টির সংসার চেয়েছিলাম, পাখিটি চাইনি।
২২/২, হাতিরপুলস্থ ফিকামলি সেন্টারের মিনি চিড়িয়াখানায় বিশ্বের ৮৭টি দেশের প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রজাতির দুর্লভ পাখি ও এক ঝাঁক চিত্রা হরিণ রয়েছে। ড. ওয়াদুদের সফল গবেষণার ফলে এদেশের আবহাওয়া, তাপমাত্রায় এসব বিদেশী পাখি নিয়মিত বাচ্চা দিচ্ছে। পাখি প্রেমিকদের এসব পাখি পরিদর্শন ও সংগ্রহ করার সুযোগ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.