প্রশাসনে বাধ্যতামূলক অবসরের খড়গ আবার শুরু হচ্ছে

দেশের প্রশাসনযন্ত্রে আবার শুরু হচ্ছে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈঠকের খবরের পর এ অস্ত্রটি প্রয়োগের চিন্তা করছে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা। এজন্য মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে প্রণীত ৩৫ জনের তালিকা নিয়ে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। ১৯৭৪ সালের গণকর্মচারী অবসর আইনের ৯ (২) ধারামতে, সরকারি চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার  যে কাউকে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে। অথবা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিজেও অবসর নিতে পারেন। স্বেচ্ছায় অবসর নেয়ার ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। বিপত্তি ঘটে থাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার ক্ষেত্রে। চাকরিবিধিতে জনস্বার্থে অবসর দেয়ার বিধান থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা দলীয় স্বার্থেই করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈঠকের পর ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের যে সব কর্মকর্তা অনেক দিন ধরে ওএসডি হয়ে আছেন তাদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে আওয়ামী লীগ বৈরী বিবেচনায় ৩৯ জন আমলাকে চিহ্নিত করে। এ তালিকা থেকে এরই মধ্যে অতিরিক্ত সচিব নাসিমুল গনি ও একেএম আকমল হোসেন আজাদ এবং যুগ্ম সচিব ড. এমএ মোমেন ও মো. শফিউল্লাহকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। এ সব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে ওএসডি ছিলেন। অবসরে পাঠানো ছাড়া বাকি ৩৫ জনের তালিকায় রয়েছেন- ১৩ জন অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব পদের ১৩ জন এবং উপ-সচিব পদমর্যাদার চার জন কর্মকর্তা। বাকিরা সিনিয়র সহকারী সচিব ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। এর বাইরে কর্মচারীদের একটি তালিকা তৈরির কাজ করছে সরকারপন্থি বলে পরিচিত কর্মচারীরা। এদিকে গত দুই দিন সরকারি ছুটির মধ্যেও বাধ্যতামূলক অবসর তালিকার খোঁজ করছেন জামায়াত ও বিএনপিমনা বলে পরিচিত কর্মকর্তারা। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকারের ঊর্ধ্বতন এবং মিডিয়া কর্মীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। নিজের নাম রয়েছে কিনা দেখার চেষ্টা করছেন। নাম দেখা ছাড়াও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তারা। চাকরির শেষ জীবনে হেনস্থা হতে হয় কিনা এ নিয়ে রয়েছেন অজানা শঙ্কায়। সরকারপন্থি বলে পরিচিত কর্মচারীরা তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের দুঃসময়ে কেউ পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। পরিবারের সদস্য অন্য কোন শুভাকাঙ্ক্ষী  শোনাচ্ছেন না আশার বাণী। হঠাৎ করে বাধ্যতামূলক অবসরের এমন খড়গে দীর্ঘদিন ওএসডি হয়ে থাকা কর্মকর্তারাই শুধু আতঙ্কিত নন- তাদের পাশাপাশি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএস-এপিএস, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জেলার ডিসি বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা এখনই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। উল্লেখ্য, গত মেয়াদে মহাজোট সরকারের আমলে প্রথম চার বছরে প্রশাসনে বাধ্যতামূলক অবসরের বিষয়টি মাথায়ই আনেনি। চার বছর পর হঠাৎ করেই এ নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিক একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। মহাজোট সরকারের আমলে যেসব আমলা সুবিধাবঞ্চিত ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন, মধ্যবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে গুরুত্বপূর্ণ পদে এদের ফিরিয়ে আনতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার ছক তৈরি করে সরকার। ওই তালিকা থেকে প্রথম পর্বে চার জনকে অবসর দেয়া হয়। এখন শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারি কর্মচারীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এসব কর্মচারীকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে অসহযোগিতাসহ প্রশাসনে অসন্তোষ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছেন এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা হস্তান্তর করেছে। এ তালিকা ধরেই এখন অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারপন্থি কর্মকর্তাদের সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সচিবালয়ের পাশাপাশি কতিপয় কর্মচারী নেতা ও বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির নেতাদের ওপর সরকারের নজরদারি বাড়ানোর জন্য অলিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, সরকারের  শেষ সময়ে সতর্কতা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে প্রশাসনে অতিরিক্ত খবরদারি কখনওই সুফল বয়ে আনবে না। সরকারের কাজের বিষয়ে আন্তরিকতা থাকবে না কর্মকর্তাদের। এক ধরনের ভয় কাজ করবে সর্বদাই।

No comments

Powered by Blogger.