কোটি টাকার বদলি বাণিজ্য করেছেন আতোয়ার

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী সাবেক মহাপরিচালক মোহাম্মদ আতোয়ার রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও বদলি বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। আতোয়ার রহমান এক বছরেরও কম সময় দায়িত্ব পালনকালে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে অধিদফতরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গণহারে বদলি করেন। এমনকি একাধিক কর্মকর্তাকে বদলির এক মাসের মাথায় ফের বদলির আদেশ দেন। অভিযোগ রয়েছে ‘লাভজনক জায়গায়’ প্রতিটি বদলির ক্ষেত্রে মোটা অংকের ঘুষ নিয়েছেন তিনি। খোদ মহাপরিচালকের এই বদলি বাণিজ্যে সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন অধিদফতরের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে তারা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি হতে সক্ষম হয়েছেন। এরপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট জায়গায় গিয়ে সুদে আসলে ঘুষের টাকা তোলার জন্য মরিয়া হয়ে ঘুষ বাণিজ্যে নেমে পড়েছেন। আর উচ্ছন্নে যাচ্ছে যুবসমাজ। যেখানে অবৈধ মাদক নিয়ন্ত্রণ করার কথা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সেখানে ঘুষের টাকা তুলতে গিয়ে যত্রতত্র মাদক বাণিজ্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এক শ্রেণীর কর্মকর্তা। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, আতোয়ার রহমান তার ঘুষ বাণিজ্য গোপন রাখতে অভিনব কৌশলও অবলম্বন করেন। সরাসরি নিজে ঘুষের টাকা না নিয়ে তিনি তার কথিত ভায়রা ভাই ঢাকা মহানগর পুলিশের একটি থানার ওসির মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইতিহাসে এতবড় বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ অতীতে আর কোনো মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠেনি। সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা এখন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্টে (বিআইএম) কর্মরত আছেন। সূত্র বলছে, অতিমাত্রায় ঘুষ, দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। বিদেশে থাকাবস্থায় তাকে বদলি করা হলেও তিনি এই ঘুষের চেয়ারে বহাল থাকতে মরিয়া হয়ে তদবির করেন। ফলে বদলি করার পর আরও প্রায় ২ মাস তিনি স্বপদে বহাল ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি।
জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মোট জনবল প্রায় এক হাজার। এর মধ্যে ৭০০ জনবল মাঠ পর্যায়ে কাজ করে। এর মধ্যে আতোয়ার রহমান তার মেয়াদকালে ২৮০ জনকেই বদলি করেন। তিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে মাত্র ১১ মাস ৩ দিন কর্মরত ছিলেন। এই স্বল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলির ঘটনা এই অধিদফতরে আর কখনও ঘটেন।
সূত্র জানায়, মোহাম্মদ আতোয়ার রহমান গত বছর ১১ নভেম্বর মহাপরিচালক হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে যোগ দেন। প্রথমে তিনি সৎ কর্মকর্তা হিসেবে অধিদফতরের সর্বত্র নিজেকে জাহির করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই মুখোশের আড়ালে থাকা তার আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। আতোয়ার রহমান সবচেয়ে বড় বদলি বাণিজ্য করেন চলতি বছরের ১৭ জুলাই। ওই তারিখে ৭ জন ইন্সপেক্টরকে একযোগে বদলি করা হয়। এই বদলি আদেশে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সবচেয়ে ‘লাভজনক’ জায়গা হিসেবে পরিচিত রাজধানীর গুলশান সার্কেলে বদলি করেন অধিদফতরের অদক্ষ ও স্বল্প শিক্ষিত ইন্সপেক্টর হিসেবে পরিচিত ইন্সপেক্টর লায়েকুজ্জামানকে। তাকে উত্তরা সার্কেল থেকে নিয়ে এসে গুলশান সার্কেলের দায়িত্ব দেয়া হয়। লায়েকুজ্জামানকে গুলশান সার্কেলের দায়িত্ব দেয়ায় হতবাক হয়ে যান অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কারণ, লায়েকুজ্জামান কেরানি থেকে পদোন্নতি পেয়ে ইন্সপেক্টর হন। গুলশান এলাকায় কূটনৈতিক ও বিদেশী নাগরিকদের আনাগোনা বেশি থাকায় এ সার্কেলে উচ্চ শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ ইন্সপেক্টরদের পোস্টিং দেয়ার রেওয়াজ ছিল।
সূত্র জানিয়েছে, গুলশানে ইন্সপেক্টর হিসেবে লায়েকুজ্জামানকে পোস্টিং দেয়ার জন্য আতোয়ার রহমান ২৮ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ ওঠে। লায়েকুজ্জামানের একজন ব্যাচমেট যুগান্তরের কাছে এই ঘুষ লেনদেনের চাক্ষুস বর্ণনা দেন। এই কর্মকর্তা জানান, তিনিসহ তার ব্যাচমেট একসঙ্গে গিয়ে আতোয়ারের কথিত ভায়রা ভাই নামধারী বিমানবন্দর এলাকায় কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিয়েছেন। আর লায়েকুজ্জামান গুলশানে যোগ দিয়ে আগে ঘুষের এই টাকা তোলার জন্য এখন মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গুলশান এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ গেস্টহাউস চালান কাপাসিয়ার বাসিন্দা তাজউদ্দীন ওরফে তাজু। তাজউদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, তাকে ইয়াবা দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চান লায়েকুজ্জামান। কিন্তু তার ব্যবসা খারাপ থাকায় তিনি ৬ হাজার টাকা পাঠান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে লায়েকুজ্জামান তাকে গালাগালি করে বলেন, ‘জানিস কত টাকা ঘুষ দিয়ে আমি গুলশানে পোস্টিং নিয়েছি? আমাকে বেশি মাসোয়ারা না দিলে সেই টাকা তুলব কিভাবে?’ এরপর আরও ৪ হাজার টাকা যোগ করে ১০ হাজার টাকা পাঠান তাজউদ্দীন। এ ঘটনা গত মাসের। উল্লিখিত দুটি ঘটনার (ঘুষ লেনদেনসংক্রান্ত কথোপকথন) ভিডিও ফুটেজ যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে। জানা যায়, আতোয়ার রহমান শুধু ইন্সপেক্টর বদলিতেই নয় অতিরিক্ত পরিচালক, উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, ইন্সপেক্টর, এসআই, এএসআই এমনকি সিপাই বদলিতেও ঘুষ নিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন সহকারী পরিচালক যুগান্তরকে বলেন, উপ-পরিচালক আবুল আলা মো. হাফিজুর রহমানকে অধিদফতরের সবাই অদক্ষ এবং জামায়াত-শিবিরপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে চেনেন। এই হাফিজুর রহমানকে ১০ অক্টোবর পদোন্নতি দিয়ে অধিদফতরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই পোস্টিংয়ে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন আতোয়ার রহমান। রাজশাহী অঞ্চলে কর্মরত আছেন এমন একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে যোগ দিয়েই এ অঞ্চলের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ডেকে ঘুষের রেট বাড়াতে বলেছেন হাফিজ।
আতোয়ারের বদলি বাণিজ্যের আরেকটি উদাহরণ ঢাকা গোয়েন্দা অঞ্চলের উপ-পরিচালক বদলি। এখানে পোস্টিং দেয়া হয়েছে অধিদফতরে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত উপ-পরিচালক জাফরুল্ল্যা কাজলকে। অভিযোগ রয়েছে, আতোয়ার রহমান এই পোস্টিং দেয়ার জন্য কাজলের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জাফরুল্ল্যা কাজল নিজেই তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জানিয়েছেন, তিনি ১৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে গোয়েন্দা অঞ্চলে পোস্টিং নিয়েছেন। আর পোস্টিং পেয়ে মরিয়া হয়ে ঘুষ বাণিজ্য শুরু করেছেন এই কর্মকর্তা।
গোয়েন্দা অঞ্চলের সব কর্মকর্তাকে ডেকে তিনি বলেছেন, ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক যে রেটে ঘুষ পান তাকেও একই রেটে ঘুষ দিতে হবে। কারণ দুটি পদই প্রায় সমমর্যাদাসম্পন্ন। সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর প্রতিটি মদের বার থেকে মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালকের নামে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা ঘুষ আসে। আর গোয়েন্দা শাখার উপ-পরিচালকের নামে আসে ৩ হাজার টাকা। কিন্তু এভাবে ৩ হাজার টাকা আর নেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন জাফরুল্ল্যা কাজল। তিনি এখন ৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছেন। অধিদফতরের শিবিরপন্থী কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সহকারী পরিচালক নাজমুল কবিরকে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে প্রাইজ পোস্টিং দিয়েছেন আতোয়ার রহমান। সূত্র জানিয়েছে, ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে নাজমুল কবিরকে বগুড়া উপ-অঞ্চলের সহকারী পরিচালক হিসেবে পোস্টিং দেন তিনি। বগুড়া উপ-অঞ্চল লাভজনক জায়গা হিসেবে অধিদফতরে পরিচিত।
জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে ‘লাভজনক জায়গা’ বলতে যে এলাকায় মাদক ব্যবসা ও মাদক ব্যবসায়ী বেশি থাকে সেই এলাকাকে বোঝায়। এর বাইরে যেসব এলাকায় মদের বার, ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যার হাউস ইত্যাদি নারকোটিকস সংক্রান্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সে এলাকাকে লাভজনক এলাকা বলে ধরা হয়। কারণ নারকোটিকস সংক্রান্ত ব্যবসা করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্য মাসোয়ারা দিতে হয়।
বক্তব্য : ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে আতোয়ার রহমান যুগান্তরকে বলেন, সবটাই অপপ্রচার। তিনি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। দাফতরিক প্রয়োজনে যাদের বদলি করা দরকার নিয়ম মেনেই তাদের বদলি করা হয়েছে। গুলশানে ইন্সপেক্টর বদলিতে মোটা অংকের ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ইন্সপেক্টর লায়েকুজ্জামানকে গুলশান সার্কেলে পোস্টিং দেয়ার জন্য একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তদবির ছিল। এক্ষেত্রে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ সঠিক নয়।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক জাফরুল্ল্যা কাজল, অতিরিক্ত পরিচালক হাফিজ, সহকারী পরিচালক নাজমুল ও ইন্সপেক্টর লায়েকুজ্জামানও ঘুষ দিয়ে পোস্টিং নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা নিজেরাও কোনো ঘুষ বাণিজ্য করেন না বলে দাবি করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.