সিলেটে দুই দশকে ৪০ ‘ছাত্রনেতা’ খুন by ওয়েছ খছরু

শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক খুনিদের নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র এখন সিলেট। চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। খুনিরা গত দুই দশকে প্রকাশ্যে খুন করেছে অন্তত ৪০ ছাত্রনেতাকে। যারা মারা গেছেন তাদের অনেকেরই নাম হারিয়ে যেতে বসেছে জনস্মৃতি থেকে। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারা তলিয়ে গেছেন বিস্মরণে। রাজনৈতিক প্রভাবে কোন কোন খুনের ঘটনা চাপা পড়ে গেছে। সর্বশেষ সিলেটের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী সুমন দাস খুনের ঘটনার পর রীতিমতো আতঙ্ক নেমেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এ সব কারণে আগে থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে শুরু করেছে। শাবি’র ঘটনার পর এক সহকারী প্রক্টর নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হলে ছাত্রলীগের অস্ত্রাগার রয়েছে। এ কারণে তুচ্ছ ঘটনায় ক্যাম্পাসে গোলাগুলি হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কথায় কোন কান দেয়নি। ওদিকে, ছাত্রলীগ নেতা খুনের ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত কোন হলেই তল্লাশি চালায়নি পুলিশ। ঘটনার পর জালালাবাদ থানা পুলিশ নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় ছাত্রলীগ ক্যাডার শিপলুর বাসায় অভিযান চালিয়ে একটি রিভলবার ও ১৯টি রামদা উদ্ধার করেছে। এর বাইরে আর কোন সফলতা নেই পুলিশের। সিলেটের অন্যতম বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। গত ৬ বছরে সেখানে ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রকাশ্যে বহুবার অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। অন্তত ১০ বার হয়েছে গোলাগুলি। ওখানে অস্ত্র উদ্ধার নেই। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এমসি কলেজ, মদনমোহন কলেজ, সরকারি কলেজ, ভেটেরিনারি কলেজ, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজসহ এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ঘাতকের অস্ত্র কোন মেধাবীর প্রাণ কেড়ে নেয়নি। আর এ কারণে অভিভাবকরাও সন্তানদের ক্যাম্পাসে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সিলেট নগরীর খুলিয়াপাড়ায় ছাত্রদল কর্মী কামাল আহমদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে একই এলাকায় কামাল গ্রুপের হামলায় নির্মমভাবে খুন হয় সিলেটের মদন মোহন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সোহান ইসলাম। গত ২৯শে জুন টমটম স্ট্যান্ড দখলকে  কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ ইব্রাহিম কচি। গত ২৮শে জুন সন্ধ্যায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নিজ দলের ক্যাডারদের হাতে খুন হন গোবিন্দগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জিল্লুল হক জিলু। দলীয় ক্যাডাররা রাতের আঁধারে নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকায় নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করে জিলুকে। এ ঘটনায় সিলেট ছাত্রদলে এখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৬ ছাত্রদল কর্মীকে সোমবার জেল হাজতে পাঠিয়েছে আদালত। খুনিদের গ্রেপ্তার করতে রোববার ছাতকে অভিযান চালায় পুলিশ। সূত্র জানায়, ছাত্রদলের মীরবক্সটুলা গ্রুপের হাতে খুন হন জিলু। গত ৪ঠা জুন চাঁদা না দেয়ায় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস শেষ বর্ষের ছাত্র  তৌহিদুর রহমানকে ‘টর্চার  সেলে’ নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ ঘটনায় পুলিশ সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেনকে গ্রেপ্তার করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবু সিনা ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের কর্মীরা টর্চার সেল গড়ে তুলেছিল। আর এই টর্চার সেলে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয় তৌহিদকে। ছাত্রলীগ নেতা জগৎজ্যোতি হত্যাকাণ্ডটি নাড়া দিয়েছে সিলেটবাসীকে। সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী। এ কারণে বিরোধীরা তাকে খুন করে বলে জানায় তার সহযোগীরা। জগৎজ্যোতি খুনের ঘটনায় জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০১২ সালে নিজ দলের ক্যাডারদের হাতে শিবগঞ্জে খুন হন ছাত্রদল  নেতা মেহরাব সিদ্দিকী সজীব। খুনিরা বাসার ভেতরে গিয়ে খুন করে তাকে। সজীবের পিতা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী এ ঘটনায় ছাত্রদল কর্মীদেরই আসামি করে মামলা করেন। একই বছরের ২২শে মার্চ ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে খুন হন ছাত্রদল নেতা মাহমুদ  হোসেন শওকত। এ হত্যা মামলার জামিন নিতে গিয়ে গুম হন মহানগর ছাত্রদল  নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেল আহমদ। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর ছাত্রদল কর্মীদের হাতে খুন হন মদন মোহন কলেজের দ্বাদশ  শ্রেণীর ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী আল-মামুন শিহাব। নগরীর কাজী ম্যানশনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে নিজ বাসায় যাওয়ার পথে ছাত্রদল কর্মীদের সশস্ত্র হামলায় খুন হন তিনি। নগরীর উপকণ্ঠে চেঙ্গেরখালে ২০১১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর খুন হন শাবি’র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র দীপঙ্কর কুমার ঘোষ অনিক ও খায়রুল কবির। এ ঘটনায় পুলিশ ইতিমধ্যে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। শহরতলীর বাদাঘাটে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছিলেন তারা। ঘটনার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ২০১০ সালের ১২ই জুলাই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ  কোন্দলের বলি হন এমসি কলেজ গণিত তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। টিলাগড় এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে তাকে খুন করা হয়। ২০০৩ সালের ৭ই জানুয়ারি সিলেট সরকারি কলেজে ছাত্রদলের হাতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী আকবর সুলতান, ১৯৯৮ সালের ২৩শে মে শিবিরকর্মী মহসিন খুন হন, ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি রুহুল আমিন খুন হন, ১৯৯৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর বাবু আহমদ খুন হন, ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৯৯১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর খুুন হন ছাত্রদল কর্মী মাহবুবুল আলম, ২০০৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর খুন হন  ভেটেরিনারি কলেজ ছাত্রদল  নেতা রফিকুল হাসান সোহাগ, ২০০২ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর শিবিরের হাতে খুন হন মদন মোহন কলেজ ছাত্রদল নেতা হামিদ খান দোয়েল, ১৯৯৮ সালে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ  নেতা সৌমিত্র বিশ্বাস খুন হন, ১৯৯৫ সালে মুরাদ চৌধুরী সিপার ও মোহিন খান, ১৯৯৪ সালে এনামুল হক মুন্না, ১৯৯৩ সালের ২৩শে মে সরকারি কলেজের দুলাল, ১৯৯১ সালে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন বিশ্বনাথ ডিগ্রি কলেজের বিধান। একই বছরের ৬ই মে নগরীতে ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ  কোন্দলে খুন হন সাজু আহমদ। এরপর প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন ছাত্রদল কর্মী  সৌরভ। ১৯৮৮ সালে শিবির ক্যাডারদের হাতে খুন হন জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মুনির-ই-কিবরিয়া চৌধুরী, তপন জ্যোতি ও এনামুল হক জুয়েল। মূলত এখান থেকেই শুরু হয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এদিকে, খুনের ঘটনা ছাড়া বর্তমান সরকারের সময়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের শতবর্ষী ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ কর্মীরা।

No comments

Powered by Blogger.