মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভিউ বিতর্কের যবনিকাপাত

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ নিয়ে চলমান বিতর্কের যবনিকা টেনেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিতর্কের অবসান হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত এ রায়ে বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাতেও রিভিউ চলবে। তবে এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রুলস কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগ রুলস এ পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর ৩০ দিন সময় পাওয়া গেলেও এক্ষেত্রে ১৫ দিন সময় পাওয়া যাবে। সুপ্রিম কোর্ট এটাও স্পষ্ট করেছে, রিভিউ কিছুতেই আপিলের সম পর্যায়ের নয়। ভুল এবং ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই কেবল রায় রিভিউ হয়। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ রায় লিখেছেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এ রায়ের ফলে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানও রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে, আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায়ও আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউর সুযোগ পাবে। কাদের মোল্লার মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের পর থেকেই রিভিউ নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বরাবরই বলে আসছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভিউ প্রযোজ্য নয়। অন্যদিকে, আসামি পক্ষের দাবি ছিল, রিভিউ দায়েরে দন্ডপ্রাপ্তদের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। গত ১২ই ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই রাতেই তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলেও আপিল বিভাগ তাকে মৃত্যুদ- দেয়। তার যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারকে আপিল দায়েরের সুযোগ দিতে সে সময় আইনেও সংশোধনী আনা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালস আইন, সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্ট রুলস সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লেগে যাওয়ার প্রসঙ্গও এসেছে রায়ে। রায়ে বলা হয়েছে, রিভিউ আবেদন মেইনটেনেবল। রিভিউ আবেদনকে আপিলের সমান বিবেচনা করা উচিত নয়। আপিল বিভাগ রুলসে রিভিউ দায়েরের ক্ষেত্রে যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের অধীনে রায়ের রিভিউর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে ১৫ দিনের সময়সীমা অনুসরণ করতে হবে এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হবে। আপিল বিভাগের মৃত্যুদ-ের রায়ের প্রেক্ষিতে মৃত্যুপরোয়ানা জারির আদেশ কারাকর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছালে কারাকর্তৃপক্ষ তাকে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ দেবেন। একই সঙ্গে তাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিতে হবে। যদি কোন রিভিউ অথবা প্রাণভিক্ষার আবেদন দায়ের করা হয় ওই আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদ- কার্যকর করা যাবে না। সুতরাং বর্তমান পরিবর্তিত অবস্থায় জেল কোডে উল্লিখিত সাত দিন অথবা ২১ দিনের বিধান প্রযোজ্য হবে না। রায়ে বলা হয়, যখনই কোন আবেদন ও আপিলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন আদালতের দায়িত্ব মেরিটে যাওয়ার আগে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের নিষ্পত্তি করা। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদের অকার্যকরতার কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে  প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ ক্ষমতা বাতিল করা হয়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনের ১১ (৩) ধারারও ব্যাখ্যা দেয়া হয় রায়ে। এতে বলা হয়, এ আইনে স্পষ্টভাবেই বিচার কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি আপিল নিষ্পত্তিতেও সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে, যদিও তা নির্দেশনামূলক। এসব বিধান সমন্বিতভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইনে বর্ণিত অপরাধের বিচার যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধে যুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করতে এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণেই এটা ঘটেছে। দেশের মানুষ এই সব ঘৃণিত অপরাধীর বিচার দেখতে চায়। কাদের মোল্লার রিভিউ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আলাদাভাবে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগ রিভিউর সুযোগ রেখেছে। তবে ১৫ দিনের মধ্যে এ আবেদন দায়ের করতে হবে এবং আবেদন দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, কামারুজ্জামানের মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই আমরা রিভিউ আবেদন করবো।

No comments

Powered by Blogger.