ঘুষ দুর্নীতির শীর্ষে প্রকৌশলী শহিদুর রহমান

এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহিদুর রহমান প্রামাণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য অনৈতিক উপায়ে সনদ নিয়েছেন। রয়েছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে এলজিইডি থেকে তার বিরুদ্ধে ৫টি বিভাগীয় মামলা দায়েরের প্রস্তাব পাঠানো হলেও তিন মাস যাবত মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। অজ্ঞাত কারণে মামলা দায়েরের অনুমতি মিলছে না। ওদিকে গত মাসে তাকে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পটুয়াখালী জেলায় বদলি করা হলেও তিনি সেখানে যোগ দেননি। এলজিইডির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চাকরিজীবনে অসদুপায়ে শহিদুর রহমান নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করা হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার তিন পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাবস্থায় তার বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ আত্মসাতের মামলা হয়। এছাড়া যশোর, রাজশাহী, নোয়াখালীসহ যেসব স্থানে তিনি চাকরি করেছেন সেখানে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। পরে তদবির করে শহিদুর রহমান এলজিইডির সদর দফতরে পোস্টিং নেন। এরপর কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে আমব্রেলা প্রজেক্টের মতো সবচেয়ে বড় প্রকল্পে যোগ দেন। পিকে চৌধুরীকে সরিয়ে তিনি এই প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব নেন। আমব্রেলা প্রজেক্টের আওতায় ওই সময় সারা দেশে সংসদীয় আসনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ করা হয়। এলজিইডি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্রকল্প থেকে শহিদুর রহমান ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহার করে এলজিইডির অন্য প্রকৌশলীদের কাছ থেকে উৎকোচ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের প্রথম তালিকায় তার নাম ছিল। তিনি ওই সময় নোয়াখালী জেলায় কর্মরত ছিলেন। সেনাবাহিনীর একজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার ভাইয়ের মাধ্যমে তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের তালিকা থেকে রক্ষা পান। ওই সূত্রে হঠাৎ তিনি ব্যাপক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন এবং এলজিইডির অন্যতম প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় তার একটি ব্যাংক একাউন্টে ২০০২ সালের ৪ মে চেকের মাধ্যমে ১৮ লাখ টাকা, ২০ সেপ্টেম্বর দু’টি পে-অর্ডারে ২৫ লাখ টাকা, ২০০৩ সালের ১২ জুন চেকের মাধ্যমে ৯ লাখ টাকা, ২০০৪ সালের ২২ এপ্রিল ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২৩ মে অপর একটি চেকে বড় অংকের অর্থ জমা হয়। এসব অর্থের কোনো বৈধ সোর্স নেই এবং তার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো ঘুষের টাকা।
শহিদুর রহমান মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেটি তার নিজের এবং ফ্ল্যাটটির বর্তমান বাজার মূল্য কোটি টাকার ওপরে। এই এলাকায় তার আরও একটি ফ্ল্যাট আছে। এছাড়া নামে-বেনামে ১৬১/১ মালিবাগ বাজার রোডে একটি বাড়ি, মেরুল বাড্ডায় আরও একটি বাড়ি এবং গাজীপুরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ১০ বিঘা জমি রয়েছে।
দুর্নীতিবাজ হিসেবে বিশেষ পরিচিতি পাওয়া এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণ নিয়েও জালিয়াতি করার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত সময় চাকরি করার জন্য তিনি মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভিন্ন উপায়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লায়েক আলী খান মিন্টু প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা একটি পত্রে জানিয়েছেন, তার উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের সন্তান শহিদুর রহমান প্রামাণিকের পিতা মৃত তমিজ উদ্দিন প্রামাণিক ১৯৭১ সালে চন্ডিপুর পাকবাহিনী ক্যাম্পের কুখ্যাত দালাল ছিলেন। তার পরিবার রাজাকার হিসেবে পরিচিত। তিনি কখনও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। এলাকার কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার শলু মিয়া তার নিকটাত্মীয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তার বাড়ি থেকে লুটের মালামাল উদ্ধার করা হয়। তারা এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী ও জামায়াত ঘরনার লোক বলে পরিচিত। তার ভাই স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শামীম হোসেন প্রামাণিক সক্রিয়ভাবে জামায়াতে ইসলামী মনোভাবাপন্ন।
এদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পানিসম্পদ, পরিকল্পনা ও নকশা) শহিদুর রহমান প্রামাণিককে ১২ অক্টোবর এলজিইডির সদর দফতর থেকে পটুয়াখালী অঞ্চলে বদলি করা হয়। পরদিন তাকে রিলিজও করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি তিনি সেখানে যোগ দেননি। উল্লিখিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার শহিদুর রহমান প্রামাণিক যুগান্তরকে বলেন, তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগই সত্য নয়। একটি মহল তাকে হেনস্তা করতে ষড়যন্ত্র করছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি ছুটিতে আছেন। এজন্য নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। সম্ভবত তিনি যোগ দেবেন না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিনা জানতে চাইলে শহিদুর রহমান বলেন, ‘আমার নিয়মিত চাকরির মেয়াদ রয়েছে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। তিনি এখনও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো সুবিধা নেননি।’

No comments

Powered by Blogger.