ভাসমান স্কুল

‘ভাসমান স্কুল’ এর কথা হয়ত অনেকে শুনে থাকবেন। বাংলাদেশের তরুণ স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ানের নৌকার মধ্যে এই স্কুল তৈরি করেছেন। আনন্দের খবর হল, রেজওয়ানের এই ‘ভাসমান স্কুল’ এখন একটি আন্তর্জাতিক মডেল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন চলছে এই স্কুল আর উন্নত বিশ্বে শিশুদের পাঠক্রমেও যুক্ত হয়েছে এই স্কুলের কথা।
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের শতকরা ৬৬ ভাগই গ্রামে বাস করেন। ২০০২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মৌসুমী বন্যায় দেশের এক পঞ্চমাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এই বন্যার সবচেয়ে বড় শিকার স্কুলের শিক্ষার্থীরা। বন্যার সময় দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৭ সালের বন্যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০ শতাংশ মানে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্কুল ডুবে যাওয়ার কারণে।
নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিল এলাকার সিধুলাই গ্রাম সেরকমই একটি বন্যা কবলিত গ্রাম। আর সেই গ্রামেরই সন্তান স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান পড়াশুনা শেষ করে বন্যাকবলিত শিশুদের পড়াশুনার জন্য গড়ে তোলেন নৌকা স্কুল।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, স্লোভানিয়ার মত উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে যুক্ত হয়েছে এই স্কুল
১৯৯৮ সালে তরুণ স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান প্রথমে সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা নামে একটি অলাভজনক সংস্থা গড়ে তোলেন তার নিজ গ্রামে। গ্রামটি বন্যাকবলিত এবং বড় জলাধারবেষ্টিত। রেজওয়ান চিন্তা করলেন, এ জলাধারকেই তার গ্রামের উন্নয়নে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। সে ভাবনা থেকেই তিনি নৌকার মধ্যে স্কুলের নকশা করলেন। স্থাপন করলেন ‘ভাসমান স্কুল’। ২০০২ সালে এই স্কুল যাত্রা শুরু করে। আর সেই যাত্রায় প্রথমে তার সম্বল ছিল স্কলারশিপের মাত্র ৫০০ মার্কিন ডলার। তবে এক বছর পর তিনি আরো পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার অনুদান পান। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।
সাধারণ বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের মতোই নৌকার ভেতরে শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার সবকিছুই আছে। বরং এ নৌকা স্কুল সেখানকার ভূমিতে স্থাপন করা অন্যান্য স্কুলের চেয়ে আরো বেশি আধুনিক। এ স্কুল কম্পিউটারসহ শিক্ষায় ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক অনেক ডিভাইস দ্বারা সুসজ্জিত। স্কুলের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল। এই বিদ্যুতে সন্ধ্যার পরও স্কুলের কার্যক্রম চালানো যায়, গ্রামেও আলো দেয়া যায়। এক যুগের ব্যবধানে বর্তমানে প্রায় ৯০ হাজার পরিবারের শিশুরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ভাসমান স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করছে। ২২টি স্কুলে এক হাজার ৮১০ জন শিশু পড়াশুনা করছে।
কম্পিউটারসহ শিক্ষায় ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক অনেক ডিভাইস দ্বারা এই স্কুল সুসজ্জিত
নৌকা স্কুলগুলোর দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট, প্রস্থ ১১ ফুট। একবারে ৩০ জন শিশু পাঠ নিতে পারেন একটি স্কুলে। শিশুদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও কম্পিউটারসহ তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন।
নৌকায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত অসহায় শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করে অনেক আগেই ১৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে পেয়েছেন সিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক স্থপতি মোহাম্মদ রেজওয়ান। তার প্রকল্পকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে দুটি তথ্যচিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে থাকা আরো অনেক দেশে চালু হয়েছে এই নৌকা স্কুল। এ সব দেশের মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, ফিলিপাইন্স, ভিয়েতনাম ও জাম্বিয়া।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রমে এ ভাসমান স্কুল প্রকল্প সম্পর্কে পড়ানো হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সঙ্কট মোকাবেলায় মানুষের সংগ্রামের অসাধারণ চিত্রকল্প হিসেবে। এ ব্যাপারে মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অদূর ভবিষ্যতে তলিয়ে যেতে পারে অনেক জনপদ। এছাড়া বাংলাদেশসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন দেশের জলমগ্ন অঞ্চলে জীবনয্দ্ধু একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভাসমান স্কুলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি মডেল হিসেবে দেখা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, স্লোভানিয়ার মত উন্নত দেশের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে যুক্ত হয়েছে এই স্কুল।
অসাধারণ উদ্ভাবন নৌকার মধ্যে তৈরি এই ভাসমান স্কুল নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে তথ্যচিত্র ‘ইজি লাইক ওয়াটার’। নির্মাণ করেছেন খ্যাতিমান তথ্যচিত্র নির্মাতা গ্লেন বেকার। তথ্যচিত্রটির প্রযোজক স্টিফেন স্যাপিয়েনজা। চলচ্চিত্রটিতে নৌকা স্কুলের পাশাপাশি সিধুলাই গ্রাম আর চলনবিলের দৃশ্য সংযোজিত হয়েছে। উঠে এসেছে নদীভাঙন, বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ আর জীবন-সংগ্রামের চিত্রও। তথ্যচিত্রটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রায় আট শ’ বার প্রদর্শিত হয়েছে।
তিনি জানান, পুরস্কারের টাকায় নৌকা স্কুল, সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে গ্রাম আলোকিত করার প্রকল্পসহ স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছেন। এখন তিনি কাজ শুরু করেছেন পানিতে ভাসমান সবজি চাষ এবং কৃষি খামার প্রকল্প করার লক্ষ্যে। আর ভাসমান স্কুলকে ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উন্নীত করার স্বপ্নও তার রয়েছে। তবে এর জন্য আরো বেশি তহবিল প্রয়োজন। এ তহবিলসংগ্রহ অনেক কঠিন। সেই কঠিন প্রচেষ্টাই এখন চালিয়ে যাচ্ছেন রেজওয়ান।

No comments

Powered by Blogger.