ভাড়া খাটল দুদক!

তদন্ত পর্যায়ে আসামি গ্রেফতার। দু’দফা ১২ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ। হাজতে পাঠানো। অতঃপর আসামির কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের চুক্তি। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মানের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে এভাবেই অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। অভিযোগ উঠেছে, তফসিলভুক্ত দণ্ডবিধির ১০৯ ও ৪০৯ ধারা ব্যবহার করে এভাবেই ভাড়া খেটেছে দুদক। অবশ্য দুদক বিষয়টি অস্বীকার করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এ ভূমিকা অত্যন্ত ভয়াবহ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১১ সালে চট্টগ্রামস্থ ‘এসকে স্টিল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ সুবিধা নেয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। ঋণ দেয়ার সময় গ্যারান্টার হন শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকেরই উদ্যোক্তা পরিচালক, ‘প্যারাডাইস কর্পোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক মোহাম্মদ সোলায়মান। ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর ঋণটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। পরিপ্রেক্ষিতে দায় এসে বর্তায় ব্যাংকটির পরিচালক সোলায়মানের ওপর। এ নিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে দেন-দরবার হলেও সোলায়মান অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হন।
এরই এক পর্যায়ে শাহজালাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় মোহাম্মদ সোলায়মান, তার দুই ভাইসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা [নং-২৭ (৪)১৪] করে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন মেসার্স এসকে স্টিলের অংশীদার আনম জাহাঙ্গীর, সোলায়মানের ভাই প্যারাডাইজ কর্পোরেশনের পরিচালক এনামুল হক ও আনিসুল হক। মামলাটি যাতে দুদকই তদন্ত করতে পারে সে লক্ষ্যে দুদকের তফসিলভুক্ত দুটি ধারায় (দন্ডবিধির ১০৯ ও ৪০৯ ধারা) এজাহারটি রেকর্ড করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০১৩ (সংশোধিত) অনুসারে এ দুটি ধারায় সংঘটিত অপরাধ একমাত্র দুদকই তদন্ত করতে পারবে। অভিযোগ রয়েছে, দুদকের একজন শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যের ‘অদৃশ্য’ সমঝোতায় দায়ের হয় এ মামলা। সংশ্লিষ্ট স্বার্থান্বেষী পক্ষের অভূত যোগসাজশে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে মামলাটি ‘তদন্তের’ জন্য চলে আসে দুদকে। হাজারো মামলা পড়ে থাকলেও দুদক সোলায়মানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটিকে গুরুত্ব দেয়। কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় সহকারী পরিচালক এসএম রফিকুল ইসলামকে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় তিনি চলতি বছরের ২৫ জুন রাজধানীর বিজয়নগর আকরাম টাওয়ার থেকে গ্রেফতার করেন মোহাম্মদ সোলায়মানকে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে রিমান্ড প্রার্থনা করেন। আদালত দু’দফায় ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সোলায়মানের। রিমান্ড শেষে জামিন প্রার্থনা করেন সোলায়মানের আইনজীবী। হাকিম আদালত জামিন নামঞ্জুর করে পাঠিয়ে দেন জেলহাজতে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি হিসেবে সোলায়মান বন্দি (বন্দি নং-১৯৩১৯/১৪) ছিলেন পুরো জুলাই মাস। এ সময় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের পাওনা আদায়ে মোহাম্মদ সোলায়মানের সঙ্গে ১৫ জুলাই একটি সমঝোতা চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী সোলায়মান নিজের কাছে থাকা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সমুদয় শেয়ার বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনার মধ্য থেকে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধে সম্মত হন। জানা যায়, চুক্তি সইয়ের পর দুদকের আইনজীবী সোলায়মানের জামিনে মুক্তির বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করেনি। মামলা দায়ের থেকে চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত এভাবেই অনুঘটক হিসেবে নেপথ্যে থেকে কাজ করে দুদক। সোলায়মানের কাছ থেকে আদায়ের ব্যবস্থা করে দেয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের পাওনা ৫০ কোটি টাকা ।
দুদক কর্তৃক গ্রেফতার, রিমান্ড এবং সমঝোতা চুক্তি সম্পাদনের পর মুক্তিলাভ সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ সোলায়মান যুগান্তরকে অভিমানের স্বরে বলেন, আমার ভাগ্যে জেলখানা ছিল! কারও প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই! আমি আর এখন শাহজালাল ব্যাংকের পরিচালক পদে নেই। এ বিষয়ে আর কী বলব? এ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না, প্লিজ!
এদিকে সোলায়মানকে গ্রেফতারের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করা হলেও আদায়কৃত অর্থ নিয়ে ঘটে আরেক তুলকালাম। নগদ অর্থ না থাকায় শাহজালাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মান নিজের কাছে থাকা ১ কোটি ৮৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৬০টি শেয়ার বিক্রি করতে সম্মত হয়েছিলেন বটে। কিন্তু শেয়ার বিক্রির সমুদয় টাকা ব্যাংকে এখনও জমা পড়েনি। অথচ সমুদয় শেয়ার তার আগে ক্রেতার বিও অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায়। অভিযোগ উঠেছে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্পৃক্ততায় শেয়ারের অবশিষ্ট ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেন আক্কাস মোল্লাসহ কয়েকজন পরিচালক।
সূত্র জানায়, সোলায়মানের শেয়ার কিনে নেন ব্যাংকটির আরেক পরিচালক আক্কাস মোল্লা। তবে আয়কর ফাঁকি দিতে শেয়ারগুলো কেনেন স্ত্রী শাহান আরা বেগমের বিও অ্যাকাউন্টে। সোলায়মান তার সব শেয়ার ট্রান্সফার করে দিলেও আক্কাস মোল্লা শেয়ারের ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেননি। শাহজালাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বুঝে পায়নি পুরো টাকা। দুটি চেকের মাধ্যমে ২০ কোটি ৬২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৯ টাকা ব্যাংকে জমা পড়ে। বাকি ২৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ২১১ টাকা জমা হয়নি। বলা হচ্ছে, এ অর্থ কতিপয় পরিচালক আÍসাৎ করেছেন। অথচ পুরো টাকা বুঝে না পেয়েও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিক্রয় প্রক্রিয়া ‘সম্পন্ন হওয়া’র বিষয়টি অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়েছে। পুরো মূল্য পরিশোধ না করে কিভাবে আপনার স্ত্রী ১,৮৭,৭৩,৯৬০টি শেয়ারের মালিক হলেন- জানতে চাইলে শাহজালাল ব্যাংকের পরিচালক আক্কাস মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ার কেনা হয়েছে। সব নিয়ম-কানুন মেনেই শেয়ার কেনা হয়েছে। ব্যাংকের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে। তাই পেমেন্টেরও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। শেয়ার বিক্রির পুরো টাকা বুঝে না পেয়ে কিভাবে শেয়ার ট্রান্সফার হল- জানতে কয়েকবার ফোন করা হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ফরমান আর চৌধুরীকে। বহুবার রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও পাওয়া যায়নি উত্তর।
এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাওনা আদায়ের অনুঘটক হিসেবে দুদকের কাজ করার ঘটনাকে ‘গুরুতর অভিযোগ’ বলে বর্ণনা করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। দুদকের এ ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে অত্যন্ত দুঃখজনক। দুদক একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে এ প্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হলে একদিন এটি আস্থাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
তাই দুদকের উচিত বিষয়টি পরিষ্কার করা। আরও স্বচ্ছ হওয়া। একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে অর্থ আদায়ের বিষয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু যুগান্তরকে বলেন, আসামিকে গ্রেফতার করার পর পাওনা টাকা পরিশোধ করেছে। এটি আমাদের অর্জন।
দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মামলায় কাকে গ্রেফতার করা হবে আর কাকে করা হবে না এটি দুদকের নিজস্ব বিষয় এবং দুদকের এখতিয়ার। এ জন্য কাউকে কৈফিয়ত দেবে না দুদক।

No comments

Powered by Blogger.