কাশ্মীর দখলের লড়াইয়ে বিজিপি

ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ মঙ্গলবার মোটামুটি নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছে। রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো ভোট বয়কটের ডাক দিলেও এদিন বিকাল পর্যন্ত অনেক আসনেই ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। এবারের ভোটের দিকে পর্যবেক্ষকরা সতর্ক নজর রাখছেন।  কারণ এই প্রথম রাজ্যে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি আঁটঘাট বেঁধে নেমেছে। কিন্তু কোন অঙ্কে তারা এই জয়ের হিসাব কষছে? ভারতের একমাত্র মুসলিম-প্রধান রাজ্যে একটি হিন্দুত্ববাদী দলের পক্ষে ক্ষমতা দখল কি সত্যিই সম্ভব? ‘মিশন ফরটি ফোর প্লাস’ মাত্র দুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরের কিশতওয়ারে নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে বলেছেন,  “মাত্র দুটো পরিবার পালা করে ওই রাজ্যটি শাসন করেছে আর অবাধে লুটপাট চালিয়েছে। এবার সেই রেওয়াজ ভেঙে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনুন – কীভাবে কাশ্মীরের উন্নয়ন হয় সেটা আমি দেখব।” মাত্র কয়েক মাস আগে হলেও বিজেপির এই স্বপ্ন যতটা অবাস্তব শোনাত, এখন যে আর সেটা তত অসম্ভব মনে হচ্ছে না এ কথা অবশ্য পর্যবেক্ষকরাও মানছেন। কাশ্মীরে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারাভিযান ৮৭ আসনের বিধানসভায় গরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে বিজেপি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু করেছে তাদের ‘মিশন ফরটি ফোর প্লাস’ অভিযান। প্রতিটি আসন ধরে ধরে, নির্বাচনী পাটিগণিতের অঙ্ক কষে তারা রাজ্যে নিজের জোরে ক্ষমতা দখল করার নকশাও তৈরি করেছে। এর জন্য হিন্দুপ্রধান জম্মুতে ৩৭টি ও বৌদ্ধপ্রধান লাদাখের ৪টি আসনের বাইরেও মুসলিমপ্রধান কাশ্মীর উপত্যকাতেও তাদের বেশ কিছু আসন জিততে হবে – আর তার জন্য তারা চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখছে না! কাশ্মীর রাজনীতির বিশ্লেষক অধ্যাপক কিংশুক চ্যাটার্জি বলছিলেন, “গত দুই বছরে যতগুলো রাজ্যে বিজেপি নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছে, তার সবগুলোতে বিজেপি অল আউট এফোর্ট দিয়েছে, কাশ্মীরও তার ব্যতিক্রম নয়। সাজ্জাদ গনি লোনের সঙ্গে বৈঠকের কথা আমরা জানতে পারছি – তলে তলে তারা নিশ্চয় আরও অনেক কিছুই করছে!” উপত্যকায় কয়েকটি আসন জেতার জন্য বিজেপি যেমন ভোট বয়কটের ওপর ভরসা রাখছে, তেমনি প্রচুর কাশ্মীরি পণ্ডিতকে ফিরিয়ে এনে ভোটার তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে – এবং সাজ্জাদ গনি লোনের মতো সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে সমঝোতাতেও দ্বিধা করছে না। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি? বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ পিডিপির নেত্রী মেহবুবা মুফতিও বলছেন, সম্প্রতি রাজ্যে ভয়াবহ বন্যার পর রাজ্য সরকারের ব্যর্থতায় মানুষ ক্ষুব্ধ। আর ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওপর সেই ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে বিজেপি পায়ের তলায় জমি খুঁজে পাচ্ছে। তার কথায়, “বিজেপি আজ বড় বড় কথা বলছে – কারণ তারা একটা স্পেস পেয়ে গেছে। তাদের বিভেদমূলক রাজনীতির অংশ হিসেবে তারা রাজ্যে হিন্দু মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলছে, ৩৭০ ধারা বিলোপ করার কথা বলছে। তারা কাশ্মীরি পণ্ডিত ভোট, শিখ ভোট, গুজ্জর ভোট, পাহাড়ি ভোট বা শিয়া ভোটের কথা বলছে ... অর্থাৎ তারা এই রাজ্যকে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভাগ করতে চায়, এমনকি মুসলিমদের মধ্যেও বিভেদ তৈরি করতে চায়,  যে প্রবণতা বিপজ্জনক!’ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, যিনি গত কয়েক মাস ধরে রাজ্যের মাটি কামড়ে আছেন, তিনি যে ধর্ম বা জাতপাতের এই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বা নির্বাচনী সাফল্যের গণিতটা খুব ভালো বোঝেন – সে কথা মানেন তার শত্রুরাও। জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনেও তার সফল প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছে খুব সচেতনভাবে, বলছিলেন কিংশুক চ্যাটার্জি। তার মতে, “বিজেপি খোলাখুলি সাম্প্রদায়িকতার কথা না বলেও রাজ্যে একটা মেরুকরণের চেষ্টা করছে, সেটা স্পষ্ট। এ কারণে শিয়া ভোট বা বৌদ্ধ ভোট বিজেপির পরিচিতির সঙ্গে না গেলেও তার জন্যও তারা ঝাঁপাচ্ছে।’ ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এই প্রথমবারের মতো চতুর্মুখী লড়াই হচ্ছে – বহুদিনের শরিক ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেস আলাদা লড়ছে, সেই সঙ্গে আছে বিজেপি ও পিডিপি। শেষ পর্যন্ত বিজেপি শ্রীনগরের ক্ষমতা দখল করতে পারুক বা না-পারুক, ২০১৪-এর নির্বাচন কাশ্মীরের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে যে একটা বিরাট পরিবর্তন আনতে চলেছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সূত্র: বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.