কালের পুরাণ আওয়ামী লীগ এখন কী করবে? by সোহরাব হাসান

দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এক দিনের গণতন্ত্রের মালিক ভোটাররা পাঁচ বছরের জন্য যাঁকে নির্বাচিত করেছেন, তিনি আগামী পাঁচ বছর নগর শাসন করবেন।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় জনদরদি নেতাও নির্বাচিত হওয়ার পর দলদরদি হয়ে পড়েন। এলাকার উন্নয়নকাজ করেন, তাও নিজের ও দলের স্বার্থে। জনস্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত।
চার সিটি করপোরেশনে ক্ষমতাসীন দলটির ভরাডুবির পর দেশবাসীর চোখ ছিল গাজীপুরের দিকে। এখানেও সেই ভরাডুবি ঠেকানো গেল না। তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে বহু নাটক হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমের নাটক। এরশাদের নাটক। হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে দুই পক্ষের টানাটানি। দুই দলের নেতাদের তীব্র বাদানুবাদ। বিএনপির নেতাদের নির্বাচন কমিশনে দৌড়ঝাঁপ। নালিশ। চার সিটির মতো গাজীপুরেও তারা অভিন্ন কৌশল নিয়েছিল। চাপে রাখো এবং এগিয়ে যাও। আর আওয়ামী লীগ সেই একই গান গেয়ে চলেছে। নাটকের শেষ অঙ্কে বিএনপির সমর্থক প্রার্থী জিতেছেন। হেরেছেন আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী। তবে এখানে প্রার্থীর চেয়ে বড় পরাজয় ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলটির। তাদের নেতৃত্বের। তাদের অহংকারের ও একগুঁয়েমির। গাজীপুরে নির্বাচন কেবল গাজীপুরেই সীমিত ছিল না। দুটো কাকতালীয় ঘটনা। চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগে বিশ্বব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন আর গাজীপুরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিল নির্বাচনে হারার জন্য এই দুই ঘটনাই যথেষ্ট।
দিনভর ভোটের চিত্র দেখে মনে হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ কথা রেখেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের মুহূর্তে তাঁকে যতটা নরম মনে হয়েছিল, আসলে তিনি ততটা নরম নন। চৌকস আমলা। মুক্তিযোদ্ধা। সাবেক বিচারপতিদের চেয়ে সাবেক আমলারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অধিক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। রাখছেন। কাজী রকিব উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠছে। এটি ভরসার দিক। জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো যা-ই হোক, নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশনই।
ভোট গ্রহণের আগে সিইসি বলেছিলেন, গাজীপুরকে মাগুরা হতে দেওয়া হবে না।
মাগুরায় কী ঘটেছিল? খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত মাগুরা উপনির্বাচনে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা।
আমরা মনে করতে পারি, সামরিক স্বৈরশাসকদের শাসনামলে নির্বাচন মানেই ছিল ব্যালট বাক্স দখল, ভোটারবিহীন কেন্দ্র। শতকরা ১০ জন ভোটার কেন্দ্রে না গেলেও প্রচার করা হতো, ৭০ ভাগ ভোট পড়েছে এবং অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই ধারার অবসান ঘটেছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের ফারাকটি এতই সূক্ষ্ম যে খালি চোখে দেখা যায় না। এখনো যায় না। সামরিক স্বৈরশাসকেরা কখনোই গণতান্ত্রিক হতে পারেননি। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসকেরা সামরিক শাসকদেরই বরাবরই অনুসরণ করে চলেছেন।
আর সামরিক শাসকেরা আগে বন্দুকের নলে ক্ষমতা দখল করতেন, পরে সেই ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে নির্বাচনের নাটক সাজাতেন। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি নির্বাচন কমিশনও ছিল সরকারের হুকুমবরদার। তবে সেই সময়ে ভোটারবিহীন নির্বাচনের সঙ্গে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে রোগী সেজে হাসপাতালে ভর্তি হতেও দেখা গেছে। স্বৈরশাসকের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার এটাই ছিল একমাত্র উপায়।
তথাকথিত নির্বাচনে সামরিক স্বৈরশাসকেরা আরেকটি অপকৌশলের আশ্রয় নিতেন, তা হলো মধ্যরাতে মিডিয়া ক্যু। জনগণ ভোট দিলেন এক প্রার্থীকে, রাতে মিডিয়ায় জয়ী ঘোষণা করা হলো আরেকজনকে। ১৯৮৬ সালের বহুল আলোচিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। মূল লড়াইটা হয়েছিল ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ও বিরোধী আওয়ামী লীগের মধ্যে। ফল প্রকাশের শুরুতে দেখা গেল, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ প্রার্থী এগিয়ে আছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা রয়েছেন পিছিয়ে। সে সময়ের একমাত্র টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেই খবর ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল। কিন্তু যখন দেখা গেল, ক্ষমতাসীন দলের জাঁদরেল সব প্রার্থী ভোটের দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন, তখনই ফল প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হলো। দুই দিন পর সরকারি বেতার ও টেলিভিশনে নির্বাচনী ফল পুনরায় প্রকাশ করা হয় এবং তাতে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন।
এখন সেই যেমন খুশি তেমন সাজোর নির্বাচন কিংবা ব্যালট বাক্স দখলের দিন শেষ হয়েছে। সব প্রতিযোগীই মেনে নিয়েছেন যে জিততে হলে ভোট পেতে হবে। জনগণের মন জয় করতে হবে। দলের বাঘা বাঘা নেতার রণহুংকার এখন আর ভোটারদের মন গলাতে পারে না। চার সিটি+গাজীপুরে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের মূল কারণ অতি-আত্মবিশ্বাস। দলীয় অহমিকা। বিরোধী দলের শক্তিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। হাতি নিজের শরীর নাকি দেখতে পায় না। আর আওয়ামী লীগ সব সময় নিজের শক্তি ও চেহারায় মুগ্ধ থাকে। অভিভূত হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, আপসকামিতার জন্যই দেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেবল আপসকামিতা নয়, নীতিহীনতা, আদর্শহীনতা ও রাজনীতির কারণেই একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদ এবং নব্বইয়ে পরিত্যক্ত স্বৈরাচার নিয়ত গণতন্ত্রের সবক দিতে পারছে। জয়-পরাজয়ের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। এক দল স্বৈরাচারের সঙ্গে, আরেক দল রাজাকারের সঙ্গে গভীর সখ্য গড়ে তুলেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে মাগুরা হবে না বলেছেন, তার একটি পটভূমি আছে। মানুষ ভেবেছিল, বহু প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া গণতান্ত্রিক শাসনে কারচুপির নির্বাচন আর হবে না। তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। কিন্তু হলো। মাগুরা উপনির্বাচনে বড় ধরনের কারচুপি ও ভোট চুরির ঘটনা ঘটল। তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। তিনি বলেছিলেন, যারা নির্বাচনের সময় মাস্তানি করবে, কমিশন তাদের শায়েস্তা করতে প্রয়োজনে তিন গুণ মাস্তানি করবে। কিন্তু তিনি ক্ষমতাসীন দলের মাস্তানদের সঙ্গে না পেরে সার্কিট হাউস থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন। মাগুরার সেই উপনির্বাচনই মূলত বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনকে যৌক্তিকতা দেয়। বিএনপি গণদাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আওয়ামী লীগ এখন তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা নিয়ে যত গোঁয়ার্তুমি করবে, ততই জনপ্রিয়তা কমবে। বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। সংবিধান মানুষ তৈরি করে। মানুষই তা বদলায়। সংবিধান মানুষকে বদলাতে পারে না। আওয়ামী লীগের নেতাদের মনে রাখা উচিত, স্বৈরতন্ত্রে গোঁয়ার্তুমির জায়গা থাকলেও গণতন্ত্রে নেই।
গত দুই দশকে আমাদের রাজনৈতিক সংকটের মূলে আছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসহিষ্ণুতা ও বৈরিতা। তারা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। এক পক্ষ কথার বোমা বর্ষণ করে, আরেক পক্ষ সত্যিকার বোমা ছুড়ে অন্য পক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছে। বিরোধী দলে থাকতে তারা জনগণকে নানা খোয়াব দেখায়, আর ক্ষমতায় গেলে জনগণের কথা ভুলে গিয়ে নিজের খোয়াবে বুঁদ হয়ে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন একগুঁয়েমি করছে। তারা বলছে, এই ব্যবস্থা এখন সংবিধানবহির্ভূত। অতএব মানা যাবে না। তাদের মনে থাকার কথা, বিএনপি কিন্তু তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা জারি থাকতেও ২০০৭ সালে নির্বাচন করতে পারেনি। বিএনপি সেদিন জনমতের তোয়াক্কা করেনি বলেই দুই বছরের সেনাসমর্থিত সরকার জাতির ওপর চেপে বসেছিল। বিএনপির নেতারা এখন যা-ই বলুন না কেন, এক-এগারোর দায়টা তাঁদেরই। তাঁরা প্রধান উপদেষ্টা, নির্বাচন কমিশন, ভোটার তালিকা ইত্যাদি নিয়ে ভয়ংকর কেলেঙ্কারি না ঘটালে দেশের রাজনীতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতো।
আওয়ামী লীগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়। কীভাবে, কাকে নিয়ে? নির্বাচন তো একতরফা কিংবা কেবল গৃহপালিত বিরোধী দল হওয়ার খায়েশ আছে এমন লোককে নিয়ে হবে না। সব প্রতিযোগীকে আস্থায় নিতে হবে। মাগুরার পর বিএনপি আস্থার জায়গাটি নষ্ট করেছিল। পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের আওয়াজ কেউ শুনতে চাইবে না। তাহলে সমাধান কী? সমাধান হলো আলোচনা, সংলাপ ও সমঝোতা। আশা করি, আওয়ামী লীগের নেতারা দেয়ালের ভাষা পড়ে দেখবেন।
চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল বর্তমান কমিশনের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার পর গাজীপুরেও সুষ্ঠু নির্বাচন করে তারা নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। মাঝেমধ্যে দুই দলের নেতা-নেত্রীদের কথা শুনলে মনে হয়, দেশটা তাঁদের তালুক। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। তবে মাত্রাতিরিক্ত হলে বদহজম হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমাদের ধারণা, আওয়ামী লীগের বর্তমান দুর্গতি থেকে বিএনপি শিক্ষা নেবে না। কেননা, তারা এখনই শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভালো কথাও এখন জনগণ শুনতে চাইবে না। জনগণ সাড়ে চার বছর সময় দিয়েছে। আর দিতে রাজি নয়। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগে এখন ভাটার টান লেগেছে। যেখানে হাত দেয়, সর্বনাশ হয়।
নির্বাচনে এক পক্ষ জিতবে, আরেক পক্ষ হারবে, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের আগে তাদের মধ্যে যতই ঝগড়া হোক না কেন, নির্বাচনের পর কোনো বিবাদ থাকতে পারে না। গণতন্ত্র রক্ষায় বিজয়ী প্রার্থীসহ সবাই একযোগে কাজ করবেন। এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলেন ভিন্ন পথে।
আগের লেখায় গাজীপুরের ভোটের হিসাব দেওয়ায় কোনো কোনো পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, কোনো হিসাবেই এবার কাজ হবে না। হয়ওনি। আসলে ভোটের স্থান গাজীপুর হলেও ভোটটি হয়েছে ‘জাতীয় ভিত্তিতে’। প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল গাজীপুরে আজ ‘জাতীয়’ নির্বাচন। এই নির্বাচন আগামী সংসদ নির্বাচনের বাছাইপর্ব। জাতীয় নির্বাচনে কী ফল হবে, তার একটা পূর্বাভাস পাওয়া গেল চার+গাজীপুরে নির্বাচনে।
প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এই ফলাফলকে কীভাবে গ্রহণ করেন? তাঁরা দাবি করতে পারেন, এটি স্থানীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। ২০০৮ সালের আগস্টের সিটি নির্বাচন যদি ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বাভাস হয়ে থাকে, তাহলে চার+গাজীপুরে ফল আগামী জাতীয় নির্বাচনেরই স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এখন কথা হলো, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরাজয়ের গ্লানি লাঘবের চেষ্টা করবে, নাকি নিজেদের গোঁয়ার্তুমি ও অহমিকা দিয়ে ব্যবধানটি বাড়িয়েই চলবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.