বাশার দারোগার দিকে অভিযোগের তীর by শাহীন আকন্দ

সময় তখন দুপুর ১২টা ২৪ মিনিট। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের ঝুঁকিপূর্ণ ভাদুন উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল নারী-পুরুষের সাতটি দীর্ঘ লাইন। প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে অপেক্ষায় ভোটাররা।
সবার মাঝেই স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ।
ভোটাররা অভিযোগ করেন, ভোটগ্রহণে অনেক সময় লাগছে। সারিবদ্ধভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর ভোট দেওয়ার সুযোগ মিলছে। কেন্দ্রের ৭ নম্বর কক্ষে ভোট দিতে লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ নারী ভোটার ববিতা ব্রিজেট গমেজ বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এইখানে এই দারোগাটার জন্য ভোট নিতে আরো বেশি দেরি হচ্ছে।' দারোগা কী করছেন জানতে চাইলে ববিতা বলেন, 'কতক্ষণ পরপরই তিনি ভোটকক্ষে ঢুকছেন।'
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল দুপুরে এই ভোটকেন্দ্রের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনেন। ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'পুলিশের উপপরিদর্শক আবুল বাশার নিজে সিল মেরে জাল ভোট দিয়েছেন।'
মির্জা ফখরুল এমন অভিযোগ করার পরপরই ভাদুন উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে চিত্র মেলে। দেখা যায়, কেন্দ্রের ৫ নম্বর ভোটকক্ষের অবস্থান দক্ষিণ পাশে। এটি ডেমরপাড়া, বিলাসাড়া ও নাগপাড়া এলাকার ৪৪৭ জন ভোটারের জন্য নির্ধারিত। পোশাক শ্রমিক খাদিজা বেগম ভোট দিয়ে গোপন কক্ষ থেকে বের হয়ে আসছেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে ভোট দিতে পেরে তৃপ্তি প্রকাশ করে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সকাল সাড়ে ৯টার সময় কেন্দ্রে আসছিলাম। সবেমাত্র ভোট দিতে পারলাম।' সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এই বিলম্বের কারণ জানতে চাইলেও খাদিজা বেগমের উত্তর দেওয়ার সুযোগ মিলল না। তার আগেই ওই কক্ষে ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী এম এ মান্নানের এজেন্ট আলমগীর হোসেন দেওয়ান বলেন, 'সাংবাদিক ভাই, শোনেন! বাশার দারোগা ৭ নম্বর কক্ষে ঢুকে জাল ভোট দিয়েছেন। আমরা খবর পাইয়া প্রতিবাদ করলে তিনি বেরিয়ে যান।' এম এ মান্নানের এজেন্ট জয়ন্তী রানী বিশ্বাসের কাছে গিয়ে দারোগার জাল ভোট দেওয়ার ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘক্ষণ পর বলেন, 'না, কোনো দারোগা এই কক্ষে ঢোকেননি।' এ সময় ১৪ দল সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লা খানের এজেন্ট আভা কস্তা বলেন, 'এইখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কোনো পুলিশ-দারোগা কক্ষে ঢোকেনি। আপনার কাছে কেউ মিথ্যা অভিযোগ করছে।'
দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মতিউর রহমান বলেন, 'ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকক্ষে এসে ভোট দিচ্ছেন। এইখানে পুলিশ ঢুকবে কেন!'
প্রিসাইডিং অফিসার আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাদুন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটকক্ষের সংখ্যা সাতটি- চারটি পুরুষ ও তিনটি নারী বুথ। কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা দুই হাজার ৮৮২। দুপুর ১২টা ৫১ মিনিট পর্যন্ত এখানে এক হাজার ৪২৫ জনের ভোট নেওয়া হয়। তবে কেন্দ্রের ৬ নম্বর নারী ভোটকক্ষে ভোট কাস্টিং ছিল অন্য কক্ষের তুলনায় অর্ধেক।
কেন্দ্রে একজন প্রিসাইডিং অফিসার, সাতজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও ১৪ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। দুপুর প্রায় ১টার দিকে আশপাশ দেখে নিয়ে ৫ নম্বর নারী ভোটকক্ষে ঢোকেন বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী উপপরিদর্শক মুক্তার হোসেন। তাঁকে ভোটকক্ষে ঢুকতে দেখে ছবি তুলতে গেলে ক্যামেরা দেখে দৌড় দেন তিনি। তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয়ে প্রিসাইডিং অফিসার আবুল কালাম তাঁকে ধমক দেন- 'মাতাব্বরি করেন মিয়া! আপনি বাইরে দেখবেন। আপনি কেন ভেতরে ঢুকছেন?'
কক্ষের ভেতর ঢুকে দায়িত্বরত সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার মোখলেসুর রহমানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েন- 'কোথায় কখন কে ঢুকেছে! আমি তো কোনো পুলিশকে এই কক্ষে ঢুকতে দেখলাম না। আপনাকে কেউ মিথ্যা অভিযোগ করেছে।'
দায়িত্বরত পোলিং অফিসার আতিকুর রহমানও একই সুরে কথা বলেন। তবে অপর পোলিং অফিসার দোলন শাহরিয়ার বলেন, 'তিনি একটু দেখতে এসেছিলেন। দেখেই চলে গেছেন।' আজমত উল্লা খানের এজেন্ট ফয়েজ আহমেদ বলেন, 'দারোগা সাব কক্ষটায় কোনো সমস্যা আছে কি না একটু ঘুইরা দেইখা গেছে। কোনো সমস্যা নেই।'
কেন্দ্রের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন পুলিশের উপপরিদর্শক আবুল বাশার। ৭ নম্বর কক্ষে ঢুকে কোনো প্রার্থীর হয়ে জাল ভোট দিয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ভাই, সব ভুয়া কথা। আমি কেন্দ্রের বারান্দায়ও উঠিনি। ভোটকক্ষে ঢোকার তো প্রশ্নই ওঠে না।'
কথা বলে জানা গেছে, উপপরিদর্শক আবুল বাশার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানায় কর্মরত। অন্যদিকে সহকারী উপপরিদর্শক মুক্তার হোসেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে কর্মরত।
ভোটারদের অনেকেই জানান, আবুল বাশার ও মুক্তার হোসেন কিছুক্ষণ পরপরই ভোটকেন্দ্রে ঢুকেছেন। তবে কেন্দ্রের ভেতরে তাঁদের কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
তবে এম এ মান্নানের কর্মী সাবেক ছাত্রদল নেতা আনোয়ার দেওয়ান অভিযোগ করেন, 'উপপরিদর্শক আবুল বাশার ভোটকক্ষে ঢুকে জাল ভোট দিয়েছেন। ভেতর থেকে তাঁদের এজেন্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে তাঁরা রিটার্নিং অফিসারকে ঘটনা জানালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'
এম এ মান্নানের কর্মী মো. শাহজাহান অভিযোগ করেন, ভোটকেন্দ্রের বাইরে ৫০০ গজের মধ্যে পুলিশ বিএনপি নেতা-কর্মীদের ঘেঁষতে দিচ্ছে না। অথচ কেন্দ্রের ভেতরে বীরদর্পে ঘোরাফেরা করছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা। বাইরে ছাত্রলীগ-যুবলীগ পাহারা দিচ্ছে। আর ভেতরে পুলিশ জাল ভোট দিয়েছে। তবে ভোটকেন্দ্রে প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেও জাল ভোট দেওয়ার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.