বোনের বিয়ে ভাঙার পরদিন আত্মহত্যা করেন মিতা নূর by রেজোয়ান বিশ্বাস

সেদিন সব কিছু ঠিক ছিল। সুপাত্র। ছেলে পছন্দ হয়েছে বাবা-মাসহ পরিবারের সবার। বরপক্ষেরও কনেকে পছন্দ। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ের গতিতে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ছোট বোনের হবু স্বামীকে পছন্দ হয়নি মিতা নূরের।
কোনোভাবেই বিয়ে হতে দেবেন না বলে প্রচণ্ড জেদ করেন তিনি। এ নিয়ে সবার সঙ্গেই তাঁর দ্বিমত হয়। বরপক্ষের লোকজনের সামনেই মিতা হৈচৈ শুরু করেন। থামানোর চেষ্টা করতে গেলে আরো বেশি 'সিনক্রিয়েট' করেন তিনি। ছোট বোনের বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর বাবার বনশ্রীর বাসা থেকে গুলশানে নিজের বাসার উদ্দেশে রওনা দেন মিতা। কিন্তু বাসায় না গিয়ে স্বামীর অফিসে গিয়ে সেখানেও শোরগোল করেন। অফিসের লোকজনের সামনেই এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চরম ঝগড়া হয়। কেউ একজন খবর দিলে সেখানে পুলিশ যায়। এক পর্যায়ে মেজাজ ঠাণ্ডা হয় মিতার। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু ওর কারণে বিয়েটা ভেঙে গেলে পরিবারের সবাই ওকে 'বয়কট করে'। বাবা রাগের মাথায় 'ত্যাজ্য' করবেন বলেন।
এর পরদিন 'গভীর রাতে নিজেকে হত্যা করেন' টেলিভিশন অভিনেত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মিতানূর। তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ হিসেবে গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠের কাছে এ ব্যাখ্যা দেয় পরিবার। গত সোমবার ভোরে রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসার ড্রয়িং রুমের সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পরিবারের লোকজন তাঁর মৃত্যুকে শুরু থেকেই 'পারিবারিক' কারণে আত্মহত্যা বলে দাবি করছেন। তবে কয়েকটি গণমাধ্যমসহ অনেকে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে বিনোদন জগতের অন্ধকার অঞ্চলের দিকেও ইঙ্গিত করেছে। গত ছয় দিনের তদন্তের পর পুলিশও তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই মনে করছে। ময়নাতদন্তেও সেটাই বলা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে মিতানূরের মৃত্যু নিয়ে গালগল্প না ছড়ানোর জন্য গণমাধ্যমগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
গুলশান থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ছয় দিন ধরে মিতানূরের মৃত্যুর কারণ জানার জন্য পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার মিতানূরের বাবা, মা, বোন, দুলাভাই, খালাসহ আরো কয়েকজনকে এ বিষয়ে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে তাঁরা সবাই মৃত্যুর জন্য কাউকে দোষারোপ না করে মিতানূরের আত্মহত্যা করার কথাই বলেছেন। তবে তাঁর মৃত্যুর অন্য কোনো কারণ আছে কি না তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। ময়নাতদন্তেও আত্মহত্যা প্রমাণ হয়েছে। ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।
গতকাল বিকেলে মিতানূরের গুলশানের ফ্ল্যাটে গিয়ে কথা হয় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। এ সময় পরিবারের পক্ষ থেকে মিতানূরের মেজ বোন রেহানা ফয়জুন্নেছা দাবি করেন, মিতানূর ছোট থেকেই জেদি স্বভাবের ছিল। ওর মতের বাইরে কেউ কিছু করতে পারত না। বিষয়টি মানসিক ছিল। এ নিয়ে অনেক চিকিৎসকের কাছে ওকে নেওয়ার পরও ঠিক হয়নি। সব শেষ মারা যাওয়ার আগের দিন তাঁদের বনশ্রীর বাড়িতে ছোট বোন লোপার বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তা হওয়ার কথা ছিল। সবকিছু ঠিক থাকলে সুমন নামে এক প্রকৌশলীর সঙ্গে লোপার বিয়ে সেদিনই হয়ে যেত।
বড় বোন জানান, মিতানূর এলে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে বলে তাঁরা আগে থেকেই শঙ্কিত ছিলেন। মিতার স্বভাবজাত কিছু কারণে আগে থেকেই পরিবারের লোকজন বিরক্ত ছিলেন। এরপরও এক সময় মিতানূর তাঁদের বাড়িতে আসে এবং লোপার বিয়েতে আপত্তি তোলে। এ নিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বরপক্ষের লোকজনের সামনেই তার চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। পরে অনুষ্ঠানে সবাইকে অপমান করে মিতানূর গুলশানের নিজের বাসায় চলে আসে। বাসায় ফেরার আগে স্বামী রানার অফিসে গিয়ে সেখানেও পরিবেশ নষ্ট করে। লোপার বিয়ে ভেঙে যায়। এরপর থেকে পরিবারের লোকজন মিতানূরকে বয়কট করে। বাবা রাগের মাথায় ওকে ত্যাজ্য করার কথা বলে।
রেহানা আরো বলেন, মিতানূরের ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, ক্ষোভ সবকিছুই ছিল বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। স্বামী রানার সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। সেদিন ছোট বোন লোপার বিয়েতে বাধা দিতে স্বামী রানাকেও বাধ্য করার চেষ্টা করে সে। কিন্তু রানা তার কথা শোনেনি। এ কারণে রানার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে অফিসে গিয়ে সিনক্রিয়েট করে।
রেহানা জানান, মিতা কুমিল্লায় নবম শ্রেণীতে লেখাপড়া করার সময় রানার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়। এর দুই বছরের মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়। এরপর ২৪ বছর ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অন্য কোনো কারণে কোনো সমস্যা ছিল না। মিতানূরের জেদ আর ছোট বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি বাদ দিলে তাদের সংসারে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কোনো ঝামেলাও ছিল না। দুই সন্তান ছিল তার স্বপ্ন। ওদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খুব সচেষ্ট ছিল তারা। অতিরিক্ত রাগের কারণে অনেক মানুষের সঙ্গেই মিতার ছোট ছোট মতানৈক্য ছিল। তবে সেগুলো খুবই সাধারণ মতপার্থক্য।

No comments

Powered by Blogger.