২২ বার জেলে গেছে গ্রিলকাটা রাজু by নূরুজ্জামান

চোখের পলকে ভবন বেয়ে উঠতে পারে। নামতে পারে স্পাইডারম্যানের গতিতে। তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে ঢুকে পড়ে বেডরুমে।
ল্যাপটপ, দামি মোবাইল ফোন সেট, নগদ টাকা, ডলার ও স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ছিপছিপে ও হালকা পাতলা গড়নের এ চোরের নাম রাজু। বয়স ২০-এর  কোঠায়। থাকে রাজধানীর করাইল বস্তিতে। তবে বেশির ভাগ রাত কাটায় টোকাই বেশে ফুটপাথ ও রেলপথের পাশে। ৮ বছর বয়সেই হাতেখড়ি চুরি বিদ্যার। মাঝে কেটে গেছে ১৪ বছর। এ সময়ে অসংখ্য বহুতল ভবনের দেয়াল বেয়ে উঠেছে। গ্রিল কেটে ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন ভবনের বেডরুমে। চুরি করেছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। তার প্রথম টার্গেট দামি মোবাইল ফোন, আইপ্যাড ও ল্যাপটপ। সুযোগ পেলে খুঁজতে থাকে নগদ ডলার, টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। এখন পর্যন্ত চুরির দায়ে ২২ বার জেল খেটেছে। প্রতিবারই ছাড়া পেয়েছে জামিনের সুযোগে। গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আবারও গ্রেপ্তার করছে গুলশান জোনের দুর্ধর্ষ এই চোরকে। গোয়েন্দা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, আদালতের মুহুরি মুন্না তাকে জামিনের ব্যবস্থা করে দেন। বিনিময়ে বকশিশ দেন চুরি করা ল্যাপটপ, কখনও স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা। ফলে কারাগারে ঢুকলেও সেখান থেকে বের হওয়া তার জন্য ‘মামুলি ব্যাপার’। তার দল নেতার নাম বাবলু। মূলত তার হাত ধরেই গ্রিলকাটা চুরির পেশায় নেমেছে। বাবলুর জন্য অন্তত ৪জন আইনজীবী নিয়োগ করা আছে। ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগাম জামিনের ব্যবস্থা করে তারা। বেশির ভাগ সময় নগদ পয়সা ছাড়াই তার পক্ষে ওকালতি করেন ওই আইনজীবীরা। ওই চোরের দলে বাবলুর আপন ভাই বাবু পাগলা রয়েছে। এছাড়া সাইফুল ও পাকিস্তানি মনির নামে আরও দুই সহযোগীও আছে তাদের দলে। সে জানায়, চোর হলেও তাদের নিজস্ব ধর্ম আছে। অভিজাত এলাকার বাইরে কখনও চুরি করে না। গ্রিল কেটে দামি আসবাবপত্র লুটে নিলেও আঘাত করে না গৃহকর্তাকে। রাস্তায় ছিনতাই করার সুযোগ পেলেও ওই অপরাধের পথে পা বাড়ায় না কখনও। রাজু জানায়, দিনের বেলা সে রিকশা চালায়। যাত্রী ছাড়াই ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন সড়কে। রেকি করে বুঝে নেয় লোকজনের ভিড় কম কোন এলাকায়। কোন বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন। পলায়ন সহজ কোন পথে। এমন নিখুঁত ছক তৈরি করে চুরির টার্গেটে নেমে পড়ে। রাতে এসে দেয়াল বেয়ে ওঠে সে ভবনে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতরে ঢুকে চুরি করে সটকে পড়ে। সে জানায়, কখনও কখনও রাত গভীর হলে মালামাল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। পথে ছিনতাইকারী কিংবা পুলিশের মুখে পড়তে হয়। তাই চুরি করা মালামাল বস্তায় ভরি। পাশের যে কোন রেল লাইন কিংবা সুবিধাজনক ফুটপাথে শুয়ে পড়ি। ঘুমানোর ভান করে ভোরের জন্য অপেক্ষা করি। ভোর হলেই কাগজ টোকাইয়ের ছদ্মবেশে মালামাল নিয়ে সরাসরি চলে যাই গুলিস্তান চোরাই মার্কেট ও স্টেডিয়াম এলাকায়। সেখানে একটি দামি  ল্যাপটপ বিক্রি করি ১০ হাজার টাকায়।  আইফোন ও আইপ্যাড বিক্রি করি পাঁচ হাজারে। নগদ ডলার কিংবা স্বর্ণালঙ্কার পেলে তা রেখে দেই আদালত পাড়ার জন্য। রাজু বলে, যে কোন ভবনের তিন থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত ওঠা তার জন্য খুবই সহজ। যে বাসায় বাতি জ্বলে না, সে বাসার গ্রিল কাটা শুরু করি। নিঃশব্দে কাজ করার জন্য গ্রিলে কাপড় পেঁচিয়ে রেঞ্জ দিয়ে চাপ দেই। এতে শব্দ কম হয়। বাসায় ঢোকার পর অনেক সময় নারী-পুরুষকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পাই। তবে ওই দিকে বেশিক্ষণ তাকাই না। তাতে ধরা পড়ার ভয় থাকে। কোন কারণে গৃহকর্তা জেগে উঠলে মালামাল না নিয়েই দ্রুত পালিয়ে যাই।
রাজুর পিতার নাম লোকমান হোসেন। বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে। ৮ বছর বয়সে বাবা-মা’র হাত ধরে প্রথম ঢাকায় আসে। ওঠে রাজধানীর করাইল বস্তিতে। তখন তার পিতা মহাখালী টিবি গেট সংলগ্ন একটি স’মিলে চাকরি করতো। মা কাজ করতো বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই ঘুরে বেড়াতেন গুলশান, বারিধারা ও ডিওএইচএসের বিভিন্ন গলিতে। বস্তির ছেলেদের সঙ্গে পুকুর ও ডোবায় খেলতো। তাদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতেই রপ্ত করে চুরি বিদ্যার কৌশল। তবে প্রথম কার বাসায় চুরি করেছিল তা তার মনে নেই। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মশিউর রহমান বলেন, গত এক বছরের ব্যবধানে ডিবি পুলিশের হাতে রাজু তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন থানা পুলিশের হাতে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছে। প্রতিবারই চুরি করবে না বলে পুলিশের কাছে প্রতিশ্রুতি দিলেও কারাগার থেকে বেরিয়ে একই কাজে জড়িয়ে পড়ে। কাতার এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিদেশী নাগরিকদের বাসায় চুরি করেছে। অকপটে রাজু স্বীকার করে, যত বাসায় চুরি করেছি, তা জমাতে পারলে ঢাকায় বাড়ি করতে পারতাম। বদ নেশার কারণে টাকা ধরে রাখতে পারিনি। গাঁজা ও  ইয়াবা সেবনের পেছনে টাকা চলে যায়। বেশির ভাগ টাকা হারিয়েছি জুয়ার আসরে। একবার চুরি করলে ১০-১২ দিন চলতো। ওই টাকা ফুরিয়ে গেলে ফের চুরির টার্গেটে ঘোরাঘুরি শুরু করি। গোয়েন্দারা জানান, রাজু ও তার দলের চোরেরা অভিজাত এলাকার বাইরে চুরি করে না। নতুন ও পুরাতন ডিওএইচএস, গুলশান-১, ২, বারিধারা, ভাটারা, বাড্ডা ও জোয়ার সাহারা এলাকার বাইরে তারা যায় না। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মশিউর রহমান বলেন, রাজু পেশাদার চোর। শতাধিক চুরির ঘটনার সঙ্গে সে জড়িত। তার মাধ্যমে গুলশান জোনের পেশাদার চোর চক্র গ্রেপ্তারের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.