মিসরে ক্ষমতার পালাবদলনতুন নেতৃত্বের সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়

মিসরে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির পতনের পর তিন দিন পার হয়ে গেছে। মুরসি ও তাঁর দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘাত, সেনাবাহিনী পরবর্তী পদক্ষেপ, বিশ্ব নেতাদের প্রতিক্রিয়া আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে এখনো।
এর মধ্যেও গত এক বছরে মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। সামনে যাঁরা দেশটির ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদের জন্য অপেক্ষমাণ চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও চলছে বিচার-বিশ্লেষণ। রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি মুরসির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক প্রমাণিত হয়েছে। দেশের বিশৃঙ্খল অবকাঠামো ভবিষ্যৎ শাসকদের কোন দিকে নিয়ে যায়, এখনই বিশেষজ্ঞরা তা আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন।
গত এক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ মিসরের রাজনীতিকে গভীর সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে দেশ আরো আগে থেকেই বিপর্যয়ের মুখে আছে। মিসরের শ্রমশক্তির প্রায় এক-চতুর্থাংশ এখন বেকার। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দিনে দুই ডলারেরও কম অর্থে জীবন ধারণ করছে। রাষ্ট্রীয় ধার-দেনা রয়েছে শত শত কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান কমছে, দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বাড়ছে। ফাদেল আবু জেইদ নামে কায়রোর এক ইলেকট্রিশিয়ান বলেন, 'খাবারের দাম, জ্বালানি সংকট, যানজট- এসব বিষয়ে আগে আমাদের এত বেশি ভুগতে হয়নি। জিনিসপত্রের এত বেশি দাম আগে কখনোই দেখিনি।'
তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মিসরের ভঙ্গুর এ পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। কয়েক দশক ধরে আমলাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া, অব্যবস্থাপনাপূর্ণ ও অপচয়মূলক ভর্তুকি ব্যবস্থা, প্রশাসনের পরতে পরতে দুর্নীতি আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখন এক তুড়িতে সব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের কেন্ট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং মিসর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জশুয়া স্ট্যাচার বলেন, মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ছাড়া অন্য যে দলই ক্ষমতায় যেত, তাদের একই পরিস্থিতির শিকার হতে হতো।
মিসরের পরবর্তী শাসকদের জন্য অর্থনীতিই একমাত্র সমস্যা নয়, স্থগিত হওয়া সংবিধানও সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি করবে। ক্ষমতার পালাবদলের পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন শাসকদের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে। এই কর্তৃত্বের প্রতি বেশির ভাগ মিসরীয়র সমর্থনও আদায় করতে হবে। ব্রাদারহুডের নেতারা সামরিক কর্তৃপক্ষের নেওয়া কোনো পদক্ষেপেই সমর্থন না দেওয়ার আহবান জানিয়েছেন সমর্থকদের। সেনাবাহিনী মিসরকে হোসনি মুবারকের যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
স্থগিত হয়ে যাওয়া সংবিধানের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের জন্য বিশেষ কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মুরসিকে উৎখাতের সময় ঘোষিত রোডম্যাপে। তবে ধারা সংশোধনের সময় উদারপন্থী ও ইসলামপন্থীদের মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটালে সহিংসতা ও রক্তপাতের হুমকি আগে দিয়ে রেখেছিলেন ব্রাদারহুডের নেতারা। এ সুযোগে ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপর হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। আল-কায়েদার বর্তমান শীর্ষ নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরি নিজেই মিসরীয় বংশোদ্ভূত। সৌদি আরবে মার্কিন সেনা উপস্থিতির প্রতিবাদে ১৯৯০-এর দশকে চরমপন্থী দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। নিজের দেশে ইসলামপন্থীদের বিপদে তিনি দলবল নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।
মিসরের সামরিক বাহিনী বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবার্ট স্পিনবর্গ বলেন, 'মিসরের সেনাবাহিনী বেসামরিক নেতৃত্বের হাতেই রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা দেখতে চায়। তবে অবশ্যই সেই বেসামরিক সরকারকে সামরিক বাহিনীর শক্তি ও সুযোগ-সুবিধার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবেও দেখতে চায়।' মুবারক ও মুরসির পতনের পেছনে সেনাবাহিনীর জোরালো ভূমিকা আগামী দিনের নেতাদের মনে এই শ্রদ্ধা তৈরি করবে কি না, সেই ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। সূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট।

No comments

Powered by Blogger.