মিসরে সংঘর্ষে নিহত ৩৭, এলবারাদি প্রধানমন্ত্রী

গতকাল শনিবার ভোরে মিসরের রাজধানী কায়রোসহ প্রধান প্রধান শহরের সড়কগুলোর মোটামুটি অভিন্ন দৃশ্য ছিল। আর তা হলো এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গুলির খোসা, পরিত্যক্ত হাতবোমা, ইট-পাথর ও কাচের টুকরা।
এসব দৃশ্য বলে দিচ্ছিল, আগের দিন শুক্রবার রাতে কী ভয়ংকর সংঘর্ষ হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। মিসরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জের ধরে তাঁর সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষের চিত্র এটি। গত শুক্রবার রাতভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষে ৩৭ জন নিহত এবং অন্তত এক হাজার ১০০ জন আহত হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলেও বিকেলের দিকে মুরসি সমর্থকরা আবারও কায়রোতে জড়ো হতে থাকে। আজ রবিবার মুরসির সমর্থকরা বড় ধরনের সমাবেশ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতিসংঘের প্রধান পরমাণু পর্যবেক্ষক এলবারাদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে মেনা এ তথ্য জানিয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় (বাংলাদেশ সময় মধ্যরাত) তাঁর শপথ নেওয়ার কথা। এলবারাদি প্রেসিডেন্ট মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী উদার ও বামপন্থী দলগুলোর জোট ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে মুরসি সমর্থকদের মধ্যে বিক্ষোভ এবং মিসরে রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো তীব্র হবে বলে বিবিসির প্রতিবেদক জানিয়েছেন।
এদিকে ক্ষমতাচ্যুত মুরসিকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্বহালের দাবিতে মুরসি সমর্থকদের রাস্তা না ছাড়তে আহ্বান জানিয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুড। ফলে আরো রক্তক্ষয়ী সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সংগঠনটির উপনেতা (ডেপুটি লিডার) খায়রাত আল সাতারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দেশটিতে সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সহিংসতা বন্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীসহ মিসরীয় নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সেনাবাহিনী দাবি করছে, তারা কোনো পক্ষ অবলম্বন করছে না। বিক্ষোভকারীদের নিরাপত্তাই এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর কায়রোতে সেনাবাহিনীর রিপাবলিকান গার্ড রেজিমেন্টের সদর দপ্তরের সামনে সেনাবাহিনীর গুলিতে মুরসির তিন সমর্থক নিহত হওয়ার পর দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। মুরসির সমর্থনে ইসলামপন্থীরা রাস্তায় নেমে এলে 'বিপ্লব' অক্ষুণ্ন রাখতে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্টের সমর্থকরাও রাস্তায় নেমে আসে। এতে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে কায়রোতে আট, আলেকজান্দ্রিয়ায় ১২ এবং সিনাই উপদ্বীপসহ অন্যান্য শহরে আরো ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে বিবিসি ও আল-জাজিরা জানিয়েছে, শুক্রবারের সংঘর্ষে ৩৭ জন নিহত হয়েছে।
শুক্রবার বিকেল থেকেই কায়রোর তাহরির স্কয়ারের নিকটবর্তী নীল নদের '৬ অক্টোবর ব্রিজ' এলাকায় মুরসির কয়েক হাজার সমর্থক অবস্থান নেয়। সন্ধ্যার পর তারা তাহরির স্কয়ারের কাছাকাছি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনের দিকে এগোতে থাকলে মুরসিবিরোধীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ সময় ওই এলাকাজুড়ে রাস্তায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। মুরসির সমর্থকরা ব্রিজটি বন্ধ করে দেয়। দুই পক্ষের মধ্যে এই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতেও সেনাবাহিনী বা পুলিশকে কোনো হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। এ সময় উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি হাতবোমা, পটকা ও পাথর নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটলে কমপক্ষে চারজন নিহত হয়। এ ছাড়া সংঘর্ষে কায়রোর রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে মারা যায় চারজন।
উভয় পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে মিসরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেকজান্দ্রিয়ায়। সেখান নিহত হয় ১২ জন। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আল-আকসার (লাক্সার), সিনাই উপদ্বীপ, উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেনি সায়েফ, দামানহারসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
এলবারাদি প্রধানমন্ত্রী : মিসরের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনা জানায়, এলবারাদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার তিন দিনের মাথায় তাঁর সরকারের প্রধান বিরোধী জোটের প্রধানকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিল সেনাবাহিনী। এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে আল-জাজিরার প্রতিবেদক শেরিন ট্যাড্রোস বলেন, এখন প্রধান প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে এলবারাদি কতটা ক্ষমতা পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তবে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে সেনাপ্রধান জেনারেল আল-সিসি যখন এলবারাদিকে পাশে বসিয়ে বৈঠক করেছিলেন, তাতে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি বিস্ময়ের কিছু নয়।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনার উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, এলবারাদি গতকাল বিকেলে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আদলি মাহমুদ মনসুরের সঙ্গে দেখা করেছেন। বৈঠকে তাঁর দলের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ : মিসরে শুক্রবারের সহিংস ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সেনাবাহিনীসহ সব দলের প্রতি সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, মিসরবাসীকেই ঠিক করতে হবে তারা কিভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র জেন পিস্যাকি গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, 'শুক্রবার যে সহিংসতার ঘটনা ঘটল, আমরা এর নিন্দা জানাই। আমরা সব মিসরীয় নেতাকে এর নিন্দা জানাতে এবং পরবর্তী সময়ে যাতে কোনো ধরনের সহিংসতা না ঘটে, সে জন্য তাঁদের শক্তি কাজে লাগানোর আহ্বান জানাচ্ছি।' বিবৃতিতে আরো বলা হয়, 'আমরা আশা করি, সামরিক বাহিনী এটা নিশ্চিত করবে, মিসরীয়দের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকারসহ তাদের সব ধরনের অধিকার সুরক্ষিত আছে। যারা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে, তাদের প্রতিও শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।'
এএফপি জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে উভয় সংকট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে যা ঘটল, সেটার যেমন বৈধতা দিতে পারছে না, তেমনই এর বিরোধিতাও করতে পারছে না। বিশেষ করে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি সরকারের ব্যর্থতার কারণে।
সেনাবাহিনীর বিবৃতি : সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আহমেদ আলী বলেন, 'আমরা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করছি না। বিক্ষোভকারীদের জীবন রক্ষা করাই আমাদের কাজ।' তিনি অভিযোগ করে বলেন, মুসলিম ব্রাদারহুড চেয়েছিল সেনাবাহিনীকে রণক্ষেত্রে নিয়ে আসতে। এ ছাড়া গতকাল সেনাবাহিনীর ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের কমান্ডাররা মুরসিকে ক্ষমতায় পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছে বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা আসলে একটি গুজব। সেনাবাহিনীর অভিযোগ, ব্রাদারহুড সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে।
আতঙ্কে ব্রাদারহুড নেতারা : মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তাঁর দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সমর্থক মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁদের কাউকেই জনসমক্ষে দেখা যাচ্ছে না। সংগঠনটির পক্ষ থেকে গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'তাঁরা আশঙ্কা করছেন, তাঁদের প্রত্যেক নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হতে পারে। ইতিমধ্যে সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বাকিদের বিরুদ্ধে পুলিশ ওয়ারেন্ট জারি করেছে।' ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনটির দ্বিতীয় সারি 'সুরা কাউন্সিলের' ২০০ নেতা এখন সমর্থকদের দিকনির্দেশনা দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। দলটির গাইডেন্স অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান, তাঁদের সুপ্রিম লিডার বাদাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন কাকে নেতৃত্ব দেওয়া হবে, সেটা তাঁরা ঠিক করতে পারছেন না।

No comments

Powered by Blogger.