সুরমন্দ্রিত রাত্রি! by আশীষ-উর রহমান ও হারুন আল রশীদ

দিন হলে তবু না-হয় বলা যেত, এ শুধু গানের দিন। কিন্তু গানের শুরুই হয়েছে দিনের শেষে। আগের দুই রাত চলল সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি। গতকাল শনিবার উচ্চাঙ্গসংগীতের সুরের মূর্ছনা পেরিয়ে গেল মধ্যরাতের সীমান্ত।
কী বলা যাবে তাহলে—সুরমন্দ্রিত রাত্রি!
যা-ই বলা হোক না কেন, আলাপ, বিস্তার, তান আর সারগামের সে যে কী মোহময় আচ্ছন্নতা, তা কথায় বলে বোঝানো যাবে না। সময় কখন যে কোথা দিয়ে কেমন করে ভেসে যাচ্ছিল, সে দিকে কারও মন ছিল না। গতকাল ছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন ও আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমি আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের তৃতীয় অধিবেশন। এই উৎসবের প্রধান সহযোগী প্রথম আলো। অন্য সহযোগী প্রতিষ্ঠান দ্য ডেইলি স্টার ও মাছরাঙা টেলিভিশন। গতকালের অধিবেশনটি উৎসর্গ করা হয়েছিল উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্যতম পথিকৃৎ পণ্ডিত উদয় শঙ্করের স্মৃতির প্রতি।
অধিবেশন শুরু হয় শিল্পী শশাঙ্ক মাকতেদরের খেয়াল গানের মধ্য দিয়ে। তিনি পরিবেশন করেন রাগ দেশ। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন সঞ্জয় অধিকারী। এরপর সরোদে পুরিয়া ধানেশ্রী রাগ শোনান ভারতীয় তরুণ শিল্পী আবীর হোসেন। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন সন্দ্বীপ ঘোষ।
ভারতীয় দুই শিল্পীর পর মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের খেয়ালশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। তিনি বিলম্বিত একতাল ও দ্রুত তিনতালে গেয়ে শোনান রাগ রাগেশ্রী। তাঁকে তবলায় সহযোগিতা করেন ইফতেখার আলম প্রধান। এরপর বাংলাদেশের আরেক শিল্পী এবাদুল হক সেতারে বাজিয়ে শোনান আলাউদ্দিন খাঁর অনন্য সৃষ্টি রাগ হেমন্ত। তাঁর বন্দিশটি ছিল বিলম্বিত তিনতাল ও দ্রুত তিনতালের। এই শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন সবুজ আহমেদ।
তৃতীয় দিনের অধিবেশন ছিল আগের দুই দিনের চেয়ে আলাদা। অধিবেশন শুরু হয়েছিল গান দিয়ে। প্রথম পর্বের গানের পর আলোচনা। আলোচনায় প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ঢাকায় এ ধরনের উৎসব আগে হয়নি। এই অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিই প্রমাণ করে, উচ্চাঙ্গসংগীতের সমঝদার শ্রোতার অভাব নেই। বিশেষ অতিথি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, এমন একটি আয়োজন উপভোগ করার সুযোগ সচরাচর হয় না। একসঙ্গে এত গুণী শিল্পীর গান ও বাজনা শোনা শ্রোতাদের জন্য বিরল সৌভাগ্যের।
ভারতের বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী ও সমাজকর্মী শাবানা আজমি বলেন, এত বিপুলসংখ্যক শ্রোতার সামনে এমন একটি সুশৃঙ্খল অনুষ্ঠানে নিজের কলানৈপুণ্য প্রদর্শন করা যেকোনো শিল্পীর জন্য আনন্দের। তিনি এই আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাদের এবং দর্শক-শ্রোতাদের অভিনন্দন জানান। এ ছাড়া বক্তব্য দেন আইটিসি-এসআরএর নির্বাহী পরিচালক রবি মাথুর। মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন ভারতী দেবেশ্বর।
এর আগে আলোচনার শুরুতে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মাঠটি এ ধরনের বড় সংগীত উৎসব আয়োজনে ব্যবহার করতে দেওয়ার আবেদন জানান। এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি উদ্যোগে আধুনিক মিলনায়তন নির্মাণে জমি বরাদ্দের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আবার গানের পালা। এ পর্বে মঞ্চে বসেন বহু প্রতীক্ষিত পদ্মশ্রী বিদুষী গিরিজা দেবী। তিনি ঠুমরি অঙ্গে বেহাগ রাগে খেয়াল গেয়ে শোনান ‘ঝননা ঝননা বাজে মোরি পায়েলিয়া’। এরপর গেয়ে শোনান একটি ঠুমরি ও একটি দাদরা। নির্ধারিত সময় শেষে উচ্ছ্বসিত শ্রোতাদের অতৃপ্ত রেখেই তিনি মঞ্চ ছেড়ে যান।
গিরিজা দেবীর পর মঞ্চে আসেন কত্থক নাচের মহারাজ পদ্মবিভূষণ পণ্ডিত বিরজু মহারাজ। শুরুতে তিনি তিনতালে কত্থকের বিভিন্ন মুদ্রা প্রদর্শন করেন। রাত পৌনে বারোটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় মহারাজ ঠুমরি গেয়ে শোনাচ্ছিলেন।
আজ বাজাবেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া
আজ বেঙ্গল-আইটিসি এসআরএ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের শেষ দিনের অধিবেশনে বাঁশি বাজাবেন সেনিয়া ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। অন্যান্য শিল্পীর মধ্যে থাকবেন: পণ্ডিত রাজন মিশ্র ও পণ্ডিত সাজন মিশ্র (কণ্ঠ), পণ্ডিত উলহাস কাসালকর (কণ্ঠ), বিদুষী অরুণা সায়েরাম (কণ্ঠ), ব্রজেশ্বর মুখোপাধ্যায় (কণ্ঠ), আলিফ লায়লা (সেতার) ও মুর্তজা কবির (বাঁশি)।

No comments

Powered by Blogger.