তাজরীন কর্মীদের বকেয়া বেতনের জন্য বিক্ষোভ-আজ বৈঠক, কয়েক গার্মেন্টে অগ্নি-আতঙ্ক

আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে পুড়ে যাওয়া তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের শ্রমিকরা বকেয়া বেতন পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে শনিবার সকালেও বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কের জিরাবো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে সড়ক অবরোধ করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
এ সময় অন্তত ১৫ শ্রমিক আহত হন। পরে শ্রমিকরা কারখানার পাশের একটি স্কুলের মাঠে গিয়ে দিনভর তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএর প্রতিনিধিদলের প্রস্তুতকৃত নামের তালিকায় নিজ নিজ নাম অন্তর্ভুক্ত করলেও বেতনের দেখা পাননি। বিজিএমইএ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতা না হওয়ায় তাঁরা শনিবার বেতন পাননি বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর এক কর্মকর্তা।
তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনার পর এলাকার তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল একাধিক কারখানায় আগুন আতঙ্কের ঘটনা ঘটলে শ্রমিকরা কারখানা ছেড়ে রাস্তায় এসে অবরোধ করেন।
শ্রমিক বিক্ষোভ : শনিবার সকাল ৯টার দিকে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানাটির বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা কারখানার সামনে জড়ো হতে থাকেন। এরপর তাঁরা নভেম্বর মাসের বেতন ও পরবর্তী তিন মাসের বেতনসহ মোট চার মাসের বেতন এবং শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ করতে থাকেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শ্রমিকরা বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর মহাসড়ক অবরোধ করার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে থাকেন। পুলিশের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। সকাল ১০টার দিকে শ্রমিকরা নিশ্চিন্তপুর বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশ তাঁদের ঘিরে রাখে। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিলসহ আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়কের জিরাব বাসস্ট্যান্ডের অদূরে প্যাঙ্কো এবং নিউ এজ অ্যাপারেলস লিমিটেডের কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন এবং ওই প্রতিষ্ঠান দুটির শ্রমিকদের তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় নিউ এজ কারখানার শ্রমিকরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলে হাজারখানেক শ্রমিক আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ শ্রমিক আহত হন। একপর্যায়ে শ্রমিকরা পিছু হটে ফের নিশ্চিন্তপুর প্রাথমিক স্কুলের মাঠে চলে যান।
তাজরীন ফ্যাশনসের জোহরা বেগম নামের এক শ্রমিক জানান, শ্রমিকদের নভেম্বর মাসের বেতন, আর স্টাফদের দুই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। কবে কারখানা চালু হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আগামী তিন মাসের বেতনসহ নভেম্বর মাসের বেতন প্রদানের দাবিতে তাঁরা মিছিল করছেন।
বিজিএমইএ কর্মকর্তার বক্তব্য : গতকাল শনিবার তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার উদ্দেশে নিশ্চিন্তপুর এলাকায় আসে বিজিএমইএর একটি প্রতিনিধিদল। ওই দলে ছিলেন বিজিএমইএর পরিচালক আবদুল আহাদ আনসারী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, দিনভর তাঁরা তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে যাঁরা চাকরি করতেন তাঁদের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকাভুক্ত হয়েছেন প্রায় এক হাজার ১৫০ জন শ্রমিক-কর্মচারী। কিন্তু এ তালিকায় এমন অনেক শ্রমিক রয়েছেন, যাঁরা কয়েক মাস আগে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। বিষয়টি যাচাই-বাছাই শেষে বেতন দিতে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দুপুরে শ্রমিকদের টঙ্গী এলাকায় বিজিএমইএর আইআরআই অফিসে নিয়ে বেতন দিতে চাওয়ায় তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বিকেলে সিদ্ধান্ত হয়েছে রবিবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, দুজন প্রতিনিধি, একজন সুপারভাইজার, একজন লাইন চিফ, বিভিন্ন প্রশাসনসহ কয়েকজন ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল বিজিএমইএর ঢাকার অফিসে যাবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আগুন আতঙ্কে রাস্তায় : গতকাল সাভারের জিরাবো পুকুরপাড় এলাকার মাসকাট গ্রুপের পোশাক কারখানায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুনের গুজবকে কেন্দ্র করে শ্রমিকরা কারখানার বাইরে চলে আসেন। এরপর একই এলাকার এমকো নামের পোশাক কারখানায় আগুন আতঙ্ক নিয়ে এলাকায় তুলকালাম ঘটনা ঘটে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আশপাশের কয়েকটি কারখানায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও জিরাবো-বিশমাইল সড়ক এবং আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরে পুলিশ লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় শতাধিক শ্রমিক ও পথচারী আহত হয়। এ ছাড়া আগুন আতঙ্কে হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে অন্তত ২০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
শিল্প পুলিশের উপপরিচালক মোক্তার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, মাসকাট গ্রুপের কারখানার নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম থেকে গ্যাস নির্গমনের শব্দ পেয়ে দু-একজন শ্রমিক আগুন আগুন বলে চিৎকার করলে পুরো কারখানায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে ২০ জন শ্রমিক আহত হন।
মাসকাট গ্রুপের ব্যবস্থাপক (কারিগরি) প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, কয়েকজন শ্রমিক-কর্মচারীকে নিচতলায় অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এ সময় এক কর্মচারীর ধাক্কায় কেমিক্যালের একটি ড্রাম উল্টে যায়। পরে বাতাসে ধোঁয়া ও গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়া দ্বিতীয় তলায় পৌঁছলে শ্রমিকদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
এরপর জিরাবো এলাকার আইরিশ ফ্যাশন, এমকো ফ্যাশন ও রেডিয়্যান্স নামের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা দুপুরের খাবার খেয়ে কারখানায় এসে নানা ধরনের গুজব শুনতে পান। মাসকাট গ্রুপে আগুনের ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে- এমন গুজব ছড়ানোর পর কারখানা তিনটির শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন।
এর আগে দুপুর ২টার দিকে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের পাশে নিট এশিয়া লিমিটেড নামের অন্য একটি পোশাক কারখানায় আগুন আতঙ্কে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক ৯ তলা ভবনের নিচে নেমে আসেন। শ্রমিক ও কর্মকর্তারা জানান, ছয়তলায় সুইং সেকশনে একটি টিউব লাইট থেকে স্পার্কের শব্দে শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ সময় হঠাৎ ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠলে শ্রমিকরা নিচে চলে যান। তবে এ ঘটনায় কেউ আহত হননি।

No comments

Powered by Blogger.