দুর্নীতির শাস্তি পদোন্নতি! by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

একেই বলে কপাল। দুর্নীতির দায়ে প্রথমে ওএসডি, তারপর বিভাগীয় মামলা। আর বছর ঘুরতেই বিলকুল মাফ। মুছে গেছে কলঙ্ক। জুটেছে পুরস্কার। মিলেছে পদোন্নতিও। যেখানে সারাক্ষণ চলে দুর্নীতির মহোৎসব, টাকা ছাড়া যে দপ্তরে ফাইল চলে না, কাজ এগোয় না, সেখানকার উপপরিচালক হয়েছেন মো. রাশেদুজ্জামান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, সহকারী অধ্যাপক পদের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামানকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) উপপরিচালক করে দুর্নীতির পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। গত ২৬ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে তাঁকে ওই পদায়ন করা হয়। এর আগে দুর্নীতির দায়ে ১৩ মাস ওএসডি ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ডিআইএ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম তদন্ত করে। অনেকেই বলছেন, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা টাকার বিনিময়ে তদন্ত প্রতিবেদন উল্টে দেন।
কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর পিয়ন মোহাম্মদ আলীকে অনিয়ম ও প্রতারণার কারণে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। এরপর তাঁকেও সাময়িক বরখাস্ত করতে বাধ্য হয় মন্ত্রণালয়। তবে বরখাস্ত হলেও প্রতিদিন তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে কর্মরতদের (সিন্ডিকেটের) সঙ্গে বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছেন।
দুর্নীতির পুরস্কার পাওয়া মো. রাশেদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার সবকটি থেকে মুক্ত হয়েছি। এর পরই মন্ত্রণালয় আমাকে পদায়ন দিয়েছে।' তাঁর দাবি, 'খুব কষ্ট করে এখানে পদায়ন পেয়েছি, আর সবকিছু পত্রিকায় লেখা ঠিক নয়।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র মন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ডিআইএতে রাশেদুজ্জামানের পদায়ন করিয়ে নেয়। ওই চক্রটি চার বছর ধরে ঢাকায় শিক্ষা প্রশাসনে কারা থাকবে তা ঠিক করে দেয়। এটা এক ধরনের আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে না করে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রী সৎ হলেও অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীতে মন্ত্রণালয় ভরে গেছে। এদের সংখ্যা প্রায় তিন ডজন হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার অতিরিক্ত সচিব মফিজুল হক বলেন, 'রাশেদুজ্জামানকে ডিআইএতে পদায়নের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। ওপরের নির্দেশে আমাদের কাজ করতে হয়। উল্লেখ্য, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি এই শাখা থেকে হয়।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (পরিকল্পনা শাখা) সহকারী পরিচালক পদে মো. রাশেদুজ্জামানকে পদায়ন করা হয়। পদে এসেই তিনি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বদলির বিনিময়ে ঘুষ কালচার শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি মাধ্যমিক শিক্ষার মনোন্নয়নে গঠিত 'সেকায়েপ প্রকল্পে'র আওতায় কেনাকেটা কমিটির সদস্য হন। প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের টাকায় চলে। ফলে রাশেদুজ্জামানের দুই হাত ভরে উঠতে থাকে।
প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাশেদুজ্জামান সেকায়েপ প্রকল্পে শুধু ফটোকপি করার নামে ভুয়া বিল-ভাউচার জমা দিয়ে দুই কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। একইভাবে প্রকল্পের সব কিছুতে অস্বাভাবিক কেনাকাটা ও বিল-ভাউচার দেখে সন্দেহ হওয়ায় বিষয়টি তদন্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চাপ দেয় বিশ্বব্যাংক। অনেকটা চাপে পড়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি করতে বাধ্য হয়।
২০১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব (কারিগরি) বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে তদন্ত শুরু হয়। ওই কমিটিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ড. মো. সিরাজুল হকও (রাশেদুজ্জামানের সাবেক বস) ছিলেন। তদন্তে প্রকল্পের ১২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে মূল হোতা চিহ্নিত করা হয় রাশেদুজ্জামান ও প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব বদিউল ইসলামকে। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে প্রতিবেদন দেওয়া হয়, আর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকল্প পরিচালকসহ সবাই হন ওএসডি। রাশেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় বিভাগীয় মামলাও। বদিউল ইসলাম এখনো ওএসডি হয়ে আছেন, কিন্তু ভাগ্যবান রাশেদুজ্জামানের হলো পদায়ন।
এ বিষয়ে মাউশির পরিকল্পনা শাখার প্রধান অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক বলেন, রাশেদুজ্জামানের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে যথেষ্ট জোরালো তথ্য রয়েছে। তবুও মন্ত্রণালয় তাঁকে ডিআইএতে পদায়ন করল। এ দেশে সবই সম্ভব!

No comments

Powered by Blogger.