সমকালীন প্রসঙ্গ-'মানবাধিকার' প্রতিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় যুদ্ধ করছে! by বদরুদ্দীন উমর

 লিবিয়ায় যে সাম্রাজ্যবাদী 'মানবিক' সামরিক আগ্রাসন চলছে তার ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো, সে দেশের নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে নিজেদের দখল কায়েম করে 'গণতন্ত্রপন্থি' ও 'স্বাধীনতাকামী' নামে আখ্যায়িত একদল লোককে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা।
এই লোকরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কথা বলে 'লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল' নামে একটি সংগঠন খাড়া করেছে সাম্রাজ্যবাদীদেরই পরামর্শে। গাদ্দাফি লিবিয়ার জনগণের জন্য অনেক কিছু করলেও যেভাবে ফ্যাসিস্ট কায়দায় তিনি লিবিয়া শাসন করে এসেছেন, তার বিরুদ্ধে সে দেশের নব্যগঠিত মধ্যশ্রেণীর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ ও বিরোধিতা সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষোভ ও বিরোধিতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে লিবিয়ার পূর্বদিকে অবস্থিত বেনগাজি শহরকেন্দ্রিক এক গণঅভ্যুত্থানে। কিন্তু লিবিয়ায় কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকায় সেখানে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক চিন্তার উন্মেষ হয়নি। গাদ্দাফির শাসন উচ্ছেদের জন্য ব্যস্ত হলেও কীভাবে নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা না থাকায় অভ্যুত্থান-পরবর্তী পর্যায়ে তারা দিশেহারা অবস্থায় ইঙ্গ-মার্কিন ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। গাদ্দাফি কঠোর হস্তে, ফ্যাসিস্ট কায়দায় লিবিয়া শাসন করে এলেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ার স্বাধীনতাকে সাম্রাজ্যবাদের চাপ ও হামলা থেকে রক্ষা করে এসেছেন। এটাই মার্কিন, ফরাসি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে গাদ্দাফির সব থেকে বড় 'মানবতাবিরোধী' কাজ! এর শাস্তি হিসেবেই সাম্রাজ্যবাদীরা এমন মানবিকতার আওয়াজ তুলে লিবিয়াকে গাদ্দাফিমুক্ত করে নিজেদের দখল ও নিয়ন্ত্রণ সেখানে প্রতিষ্ঠার জন্য বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে এবং শত শত মানুষ হত্যা করছে এবং গাদ্দাফিকে উৎখাত না করা পর্যন্ত তাদের সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি সহায়তায় অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তাদের হাতের মুঠোয় থেকে যদি লিবিয়ার গণতন্ত্রকামীরা লিবিয়াকে গাদ্দাফিমুক্ত করেন, তাহলে তার ফল এই দাঁড়াবে যে, লিবিয়া গাদ্দাফিমুক্ত হলেও সে দেশটি মার্কিনসহ অন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের দেশের স্বাধীনতা হস্তান্তর করে দেশের স্বাধীনতা হারাবে, যে স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরে গাদ্দাফি রক্ষা করে এসেছেন। গাদ্দাফি ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সমগ্র আরববিশ্বে লিবিয়াই একমাত্র দেশ যারা কোনো পর্যায়েই সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে পড়েনি। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব শেষদিকে সৃষ্টি হলেও প্রথমদিকে সাদ্দাম তাদের শিবিরভুক্ত ছিলেন। মার্কিনের দ্বারা প্ররোচিত হয়েই তিনি ইরানের বিরুদ্ধে যুুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু গাদ্দাফির সে ধরনের কোনো রেকর্ড নেই। তিনি অভ্যন্তরীণভাবে জনগণের স্বাধীনতা যতই খর্ব করুন সে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেশের স্বাধীনতা কোনোভাবেই খর্ব করেননি। এখন তার বিরোধী গণতন্ত্রীরা স্বাধীনতার জন্য যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন তাতে লিবিয়ার স্বাধীনতা যে সাম্রাজ্যবাদের পকেটস্থ হবে এতে সন্দেহ নেই। কাজেই গাদ্দাফি বিরোধিতার নামে বেনগাজিভিত্তিক গণতন্ত্রকামী ও স্বাধীনতাকামীরা 'লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল' গঠন করে এখন যেভাবে সাম্রাজ্যবাদকে ঘরে ঢোকানোর ব্যবস্থা করছে, তার দ্বারা লিবিয়ার জনগণ আরও বড় ফ্যাসিস্ট শক্তির অধীন হবে এবং এই ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ার তেল সম্পদ লুণ্ঠন করে লিবিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা, জনগণের বিদ্যমান সকল প্রকার অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তন করে তাদের দুর্দশার অন্ত রাখবে না।
'মানবিক অধিকার', 'মানবিকতা' ইত্যাদির নামে সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যা প্রয়োজন তার সবকিছুই করে। যেখানেই স্থানীয় শাসক শ্রেণীর, বিশেষত কোনো স্বৈরতন্ত্রী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, অভ্যুত্থান ঘটায়, সেখানেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনগণের পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হয়! সেই দেশগুলোতে বিদ্যমান শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীরা সহজেই তাদের খপ্পরে পড়ার কারণ এ দেশগুলোতে এখন কোনো সংগঠিত প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংগঠিত শক্তি, কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব না থাকা। এই শক্তির অনুপস্থিতিতে বিরোধী শক্তিরা নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে দেশীয় শাসক শ্রেণী ও স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতা করতে ও তাদেরকে উচ্ছেদ করতে অক্ষম হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের দিকেই ঝোঁকে। এভাবে ঝুঁকে তারা নিজেদের মুক্তি অর্জন করতে তো সক্ষম হয়ই না, উপরন্তু নিজেদের দেশকে সাম্রাজ্যবাদের অধীন ও তাদের লুণ্ঠনক্ষেত্রে পরিণত করে। লিবিয়ায় এখন সাম্রাজ্যবাদীরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধুয়ো তুলে অসংগঠিত এবং অপরিপকস্ফ কিছু রাজনৈতিক লোকজনের সহায়তায় তাদের দীর্ঘদিনের লিবিয়া দখলের ব্যর্থ প্রচেষ্টা সফল করতে নিযুক্ত হয়েছে।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা এ চেষ্টা করা সত্ত্বেও তাদের কাজ সহজ হচ্ছে না। কারণ একদিকে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে মধ্যশ্রেণীর কিছু লোক যুদ্ধ করলেও লিবিয়ার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ গাদ্দাফির সমর্থক। গাদ্দাফি লিবিয়ায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে উন্নতি করেছেন তার ফলে একদিকে যেমন একটি মধ্যশ্রেণী সৃষ্টি হয়ে গণতন্ত্র চাইছে, গাদ্দাফির বিরোধিতা করছে, তেমনি অন্যদিকে গাদ্দাফির অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির যারা সুফলভোগকারী তাদের একটা বড় অংশ গাদ্দাফির পক্ষে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন দিচ্ছে। কাজেই লিবিয়ার সমগ্র জনগণ গাদ্দাফিবিরোধী এটা ঠিক নয়। উপরন্তু জনগণের একটা বড় এবং উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থনের জোর গাদ্দাফির আছে এবং সে সঙ্গে আছে তার সামরিক শক্তি। এ দুইয়ের মোকাবেলা করা অসংগঠিত এবং অপরিপকস্ফ রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরিচালিত বেনগাজিভিত্তিক বিরোধীদের নেই। কাজেই তারা সাম্রাজ্যবাদীদের এসো এসো বলে ডাক দিচ্ছে এবং কেন তারা গাদ্দাফির সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আরও দ্রুত ও বড় আকারে আক্রমণ করছে না, এর জন্য হতাশা প্রকাশ করছে। আসলে তাদের নিজেদের পক্ষে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তারা চাইছে সাম্রাজ্যবাদীরাই তাদের স্বাধীন করার জন্য, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গাদ্দাফির বাহিনীকে ধ্বংস করুক। অর্থাৎ তারা গাদ্দাফিমুক্ত হওয়াকেই দেখছে তাদের স্বাধীনতা হিসেবে! কিন্তু এক্ষেত্রে এভাবে তাদের গাদ্দাফিমুক্তির অর্থ যে সাম্রাজ্যবাদের কারাগারে বন্দি হয়ে নিজেদের ও সে সঙ্গে সমগ্র দেশের স্বাধীনতা ধূলিসাৎ করা এ রাজনৈতিক বোধ-বুদ্ধি তাদের একেবারেই নেই।
এই অবস্থায় ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও খোদ লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার সাধারণ নিরীহ মানুষ হত্যা যারা করছে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে, সেই মার্কিন, ফরাসি, ব্রিটিশরা এখন লিবিয়াকে গাদ্দাফির মানবাধিকারবিরোধী কার্যকলাপ ও তৎপরতা থেকে মুক্ত করার জন্য সে দেশে বোমাবর্ষণ করছে! তারা এখন বুশের মতো করে চিৎকার করে বলছে, গাদ্দাফিকে ক্ষমতা ছাড়তেই হবে। তাকে লিবিয়া ত্যাগ করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে তারা এটা করবে এ নিয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা তাদের নেই। দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা খোঁজখবর করছেন গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর কোন দেশে তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়। এ জন্য আফ্রিকার কোনো দেশে যাতে এই ব্যবস্থা হয়, সে চেষ্টাই তিনি করছেন। (উধরষু ঝঃধৎ ১৮.৪.২০১১)
একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরে যদি ফ্যাসিস্ট শাসন থাকে তাহলে সে শাসন উচ্ছেদের কাজ সে দেশের জনগণের। অন্য কারও পক্ষে সে কাজে দখল দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু এ এখতিয়ার না থাকলেও সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে তাই করছে। লিবিয়ায় গাদ্দাফি যেভাবে দীর্ঘদিন তার শাসন চালিয়ে এসেছেন এখনও তাই করছেন, তবে পরিবর্তিত পরস্থিতিতে তিনি তার কর্মধারায় কিছু পরিবর্তনের চিন্তাও বাধ্য হয়েই করছেন। কিন্তু এতদিন সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গাদ্দাফিকে উচ্ছেদ করার অর্থাৎ সে দেশে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি। কিন্তু এখন সেখানে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য গণবিক্ষোভকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে মানবাধিকারের নামে তারা লিবিয়া দখলের যুদ্ধ চালাচ্ছে। নিজেদের সৈন্য না নামিয়ে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা 'লিবিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিল'কে দিয়ে সম্ভব নয়। এটাই এই মুহূর্তে সাম্রাজ্যবাদের বড় মাথাব্যথা। এ কারণেই তারা গাদ্দাফিকে শুধু সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিবর্তে লিবিয়াকে ঘেরাও করে, তার বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করে কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির চেষ্টা করছে। যে যুদ্ধ তারা এখন লিবিয়ার বিরুদ্ধে শুরু করেছে শত অসুবিধা সত্ত্বেও তারা গাদ্দাফিকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ থামানোর সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যে যুদ্ধ তারা এখন করছে সে অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে আর একটি বড় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অসুবিধা উপলব্ধি করে অন্য সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে নিয়ে এখন লিবিয়ায় যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক, এর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বড় রকম খেসারত দিতেই হবে।
১৮.০৪.২০১১
 

No comments

Powered by Blogger.