ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি-স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এক ধাপ অগ্রগতি

অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে ফিলিস্তিনের মানুষ। এই দীর্ঘ সময়ে তারা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট সহ্য করেছে, প্রচুর রক্ত দিয়েছে, সারা দুনিয়ায় উদ্বাস্তু হিসেবে জীবন কাটিয়েছে। অবশেষে তারা বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে অকুণ্ঠ সমর্থন পেল, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল।
জাতিসংঘে অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে ফিলিস্তিন। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি অর্জনের পথে অবশ্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এত দিন জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের মর্যাদা ছিল কেবলই একটি 'ভূখণ্ড' হিসেবে, 'রাষ্ট্র' হিসেবে নয়। গত বৃহস্পতিবার (বাংলাদেশে শুক্রবার ভোর) স্বীকৃতির মাধ্যমে পর্যবেক্ষক ভূখণ্ড থেকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নীত হলো ফিলিস্তিন। এর ফলে জাতিসংঘের 'পূর্ণ সদস্য পদ' পাওয়ার পথটি ফিলিস্তিনের জন্য আরো প্রশস্ত হলো। এখন থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিতর্কে অংশ নিতে পারবেন এবং আন্তর্জাতিক মহলে তাঁদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে পারবেন। এখন তাঁরা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) এবং জাতিসংঘের অন্য সংস্থার সদস্য পদের জন্যও আবেদন করতে পারবেন। আইসিসির সদস্য পদ পেলে এই আন্তর্জাতিক আদালতে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাওয়াও যাবে। সংগত কারণেই এই স্বীকৃতিলাভের পর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। দীর্ঘ দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় তাঁরা নতুন করে বুক বাঁধে।
বিশ্বব্যাপী পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের এই অন্তর্ভুক্তিকে একদিকে যেমন মানবতার জয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, অন্যদিকে এটিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের 'কূটনৈতিক পরাজয়' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩৮টি দেশই ফিলিস্তিনের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ মাত্র ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ৪১টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং পাঁচটি দেশের প্রতিনিধিরা সে সময় অনুপস্থিত ছিলেন। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য যে ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ডসহ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ইউরোপীয় মিত্রও এবার ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ফিলিস্তিনবাসীর ন্যায়সংগত অধিকারের প্রতি বিশ্ববাসীর যে অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে, এই ভোট তারই প্রমাণ। অথচ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল সেই ন্যায়সংগত অধিকার থেকে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করে আসছে। সপ্তাহখানেক আগেও বোমাবর্ষণ করে শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। আর ইসরায়েলের এই আগ্রাসনে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ। জাতিসংঘে এই স্বীকৃতিলাভে স্বাভাবিকভাবেই নাখোশ হয়েছে তারা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের বিশেষ মর্যাদা লাভের পরপরই বিশ্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো করে অধিকৃত এলাকায় আরো তিন হাজার বসতি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। বিশ্ব কি ইসরায়েলের এই ঔদ্ধত্যকে নীরবে সহ্য করে যাবে? না। বিশ্বজনমত ক্রমেই ইসরায়েলের অন্যায় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যাচ্ছে এবং চূড়ান্তভাবেই তাকে প্রতিহত করবে।
সারা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের মতো আমরাও আশা করি, ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ বঞ্চনার অবসান হবেই। বিশ্ববাসীর সহায়তায় তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। একই সঙ্গে আমরা এটাও আশা করি, ইসরায়েলের সমরবাদী শাসকদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং তারা গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের অধিকৃত এলাকা মুক্ত করে দেবে। সংঘাত কেবল সংঘাতই ডেকে আনে। এ পর্যন্ত সেখানে সংঘটিত যুদ্ধগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়। আমরা নতুন কোনো যুদ্ধ চাই না। আমরা চাই, প্রত্যেকে তার নিজ ভূখণ্ডে শান্তি ও সম্মানের সঙ্গে জীবনধারণের সুযোগ পাক।

No comments

Powered by Blogger.