চট্টগ্রাম সমস্যা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট by মোহাম্মদ ফয়সাল আহাম্মদ ভুঁইয়া

পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের তিনটি জেলা- খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের এক-দশমাংশ এই জেলাগুলোর অন্তর্গত; অথচ মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ জনগোষ্ঠী এই এলাকায় বিদ্যমান।
এই অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তরাংশের অধিকভাগে পাশের রাষ্ট্র ভারত ও দক্ষিণাংশের অধিকভাবে অপর রাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দরের ভৌগোলিক অবস্থানও এ অঞ্চলের অতি নিকটবর্তী। সরকারি আদমশুমারি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি ছাড়াও ১৩টি উপজাতির উপস্থিতি রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কতিপয় গবেষকের গবেষণায় কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
কালের বিবর্তনে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যম পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উপজাতি নেতা সদলবলে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তবে এ ক্ষেত্রে তৎকালীন মং সার্কেল চিফ ও তাঁর কতিপয় অনুসারী ব্যতিক্রম ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালে পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতিদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (সাবেক এমপি) কর্তৃক একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়, যার নামকরণ করা হয় 'পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি' সংক্ষেপে পিসিজেএসএস। ঠিক তার পরবর্তী সালে স্বার্থান্বেষী মহলের সহযোগিতায় ওই দল কর্তৃক একটি সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন গঠন করা হয়, যা সাধারণত 'শান্তিবাহিনী' নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে 'শান্তিবাহিনী' রাঙামাটি শহরের অদূরে সুভলং এলাকায় পুলিশের একটি টহল দলের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করে। ফলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১২১-এর আওতায় গুরুতর অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে ওই দল কর্তৃক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু তথা ইন্সারজেন্সির আত্মপ্রকাশ ঘটে। যার পরিপ্রেক্ষিতে একই সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী মোতায়েন করার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে 'কাউন্টার ইন্সারজেন্স অপারেশন'-এর অবতারণা হয়।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কায়েমের পাশাপাশি এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। এই উন্নয়নের পরিবেশকে সম্পূর্ণ কাজে লাগানোর প্রয়াসে সরকার কর্তৃক নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এই সময় সরকার কর্তৃক বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিওর সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমেও এ উন্নয়নের ধারা আরো বেশি গতিশীল ও ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। তা ছাড়া শান্তিচুক্তির আলোকে চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বজায় রাখার জন্য এরই মধ্যে সরকার কর্তৃক যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো : একজন উপজাতি সংসদ সদস্যকে প্রধান করে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক পূর্ণ মন্ত্রণালয় গঠন, সাবেক বিদ্রোহী নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমাকে প্রধান করে ২৫ সদস্যের বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিষদ গঠন এবং তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতি ব্যক্তির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন, 'ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন টাস্কফোর্স' গঠন; যার মাধ্যমে এরই মধ্যে ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩ উপজাতি পরিবারকে পুনর্বাসন, ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন (চতুর্থ কমিশন গত ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে মেয়াদ পূর্ণের পর বর্তমানে তা অকার্যকর অবস্থায় আছে), জাতীয় সংসদের উপনেতার নেতৃত্বে 'শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি' গঠন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ছাড়াও সরকার শান্তিচুক্তির শর্তবহির্ভূত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা হলো : 'পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড'-এর কার্যক্রম অব্যাহত রেখে এর চেয়ারম্যান হিসেবে একজন উপজাতি সংসদ সদস্যকে নিয়োগ প্রদান এবং ১০ সদস্যবিশিষ্ট 'পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি' গঠন।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর-পরবর্তী এক যুগেরও অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। শান্তিচুক্তি ও 'তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮' অনুসারে সরকার কর্তৃক পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় মোট ৩৩টি বিষয় বা দপ্তর হস্তান্তর হওয়ার কথা। এরই মধ্যে জেলাভেদে ২১-২৩টি বিষয় জেলা পরিষদগুলোকে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট বিষয় বা দপ্তরগুলোর হস্তান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন। শান্তিচুক্তি-উত্তরকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওগুলোর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সরকারি সহায়তা আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে এ অঞ্চলে শতাধিক এনজিও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়মূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে এ পর্যন্ত অর্ধেকেরও বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প তুলে নেওয়া হয়েছে। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বর, ২০০৯-এ পার্বত্যাঞ্চলে থেকে একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির শর্ত মোতাবেক ও সরকারি নির্দেশমতে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাস ব্যতীত নিরাপত্তা বাহিনীর অবশিষ্ট সব ক্যাম্প প্রত্যাহার কার্যক্রম বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। প্রত্যাশিত নিরাপত্তা পরিবেশ তৈরি হলে নিশ্চয়ই শিগগিরই সরকার কর্তৃক তা কার্যকর করা হবে।
পার্বত্যবাসী সাধারণ জনগণ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো শান্তিপ্রিয় ও সহনশীল। বস্তুত পার্বত্যাঞ্চলের কতিপয় আঞ্চলিক নেতা তাঁদের পদ ও ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও জিম্মি করে রেখেছেন। নেতৃস্থানীয়রা মূলত তাঁদের স্বীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এ অঞ্চলের আপামর জনগণকে প্রকৃত নাগরিক সুবিধা ও উন্নয়নের সম্ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন। বর্তমানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য ও তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে প্রায়ই এ অঞ্চলের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারি সদিচ্ছা বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও ও আন্তর্জাতিক মহলের সংশ্লিষ্টতা এবং গণমাধ্যমের নানামুখী প্রচারের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা বর্তমানে বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে একটি উপমহাদেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। বিদ্যমান সব বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও পার্বত্যবাসী সাধারণ জনগণের সহযোগিতায় সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থিতিশীল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রচলিত উন্নয়নের ধারা আরো গতিশীল এবং বাস্তবমুখী করার জন্য বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে পার্বত্যবাসী জনগণ, তথা পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বিরাজমান হিংসা-বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি-বিভেদ ও মতানৈক্য পরিহার করে স্বীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে সরকার উদ্যোগকে সফল করবেন- এই আশা করছি।

No comments

Powered by Blogger.