মধ্যপ্রাচ্য- জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির তাৎপর্য by শান্তনু মজুমদার

প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও শুভবোধের জয় হয়েছে জাতিসংঘে। বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফিলিস্তিনকে বাধ্যতামূলকভাবে বিভক্ত করার ঠিক ৬৫ বছরের মাথায় এ ঘটনা ঘটল।
উল্লেখ্য, এত দিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন জাতিসংঘে ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক সত্তা’র মর্যাদা ভোগ করত; এবার তা ‘অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’-এর মর্যাদায় উন্নীত হলো। এত দিন পর্যন্ত শুধু ভ্যাটিকানের এ মর্যাদা ছিল। ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট সাধারণ পরিষদে ১৩৮টি ভোট পড়ছে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে। জায়নবাদ পরিচালনাকারী ইসরায়েলের স্বার্থে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ইসরায়েলসহ নয়টি রাষ্ট্রের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘কোমল শক্তি’ কানাডা। বাকি ছয়টি দেশের মধ্যে চেক রিপাবলিক ছাড়া অন্যরা গুরুত্ব বিচারে অনুল্লেখ্য। এরা হচ্ছে মাইক্রোনেশিয়া, মার্শাল আইল্যান্ড, পানামা, পালাউ ও নাউরু। ভোটদানে বিরত থাকা রাষ্ট্রের সংখ্যা ৪২; এর মধ্যে আছে দুই বড় শক্তি যুক্তরাজ্য ও জার্মানি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তটিকে ‘আনফরচুনেট’ ও ‘কাউন্টার প্রডাকটিভ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরপরই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ভাষণের মধ্যে ‘উসকানি’ খুঁজে পেয়েছে ইসরায়েল। দেখা যাচ্ছে যে পাঁচ পরাশক্তির মধ্যে তিনটিই বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিপক্ষে। আর চীন বাদে অন্য পরাশক্তিগুলোর ওপর নানা মাত্রার প্রভাবসহ বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একটি অর্থাৎ ইসরায়েল তো আছেই ফিলিস্তিন ধ্বংস করার জন্য। বিপক্ষে ভোট দেওয়া ও ভোট না-দেওয়া সদস্যরা দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে থাকা শান্তি আলোচনা শুরুর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তটি শান্তি আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা বিঘ্নিত করবে বলে কথা ছড়াতে শুরু করেছে। শান্তি আলোচনা কেন বন্ধ হয়ে আছে, সে ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলা হচ্ছে না। স্মর্তব্য, নানা নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল কর্তৃক অবৈধ বসতবিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১০ সাল থেকে আলোচনা বন্ধ আছে।
বিরুদ্ধবাদীরা আরেকটি কাজ শুরু করেছেন; তাঁরা বলতে শুরু করেছেন, সাধারণ পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্তটির তেমন কোনো গুরুত্বই নেই। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত সুসান রাইস বলেন, ‘আজকের বিপুল ঘোষণাটি সহসাই ধূসর হয়ে যাবে এবং ফিলিস্তিনিরা জেগে উঠে দেখবে যে তাদের জীবনে তেমন কিছুই পাল্টেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে না।’ কিন্তু গুরুত্ব যদি না-ই থাকবে তাহলে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যাপক চাপের মধ্যে রাখছিল কেন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন? এমনকি অর্থনৈতিক অবরোধের ভয় কেন দেখানো হচ্ছিল? কেন ভোট থেকে সরে আসার আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বুধবার ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট বিল বার্নসকে পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কাছে?
আসলে গুরুত্ব আছে। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিশাল গুরুত্ব আছে। প্রথম কথা হচ্ছে, এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের নামের সঙ্গে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি যুক্ত করেছে। আর এর ফলে সাধারণ পরিষদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার না পেলেও ফিলিস্তিন এখন থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিতে পারবে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টও (আইসিসি) অন্তর্ভুক্ত। ধরে নেওয়া যায়, এটাই ইসরায়েল ও ইসরায়েলের বন্ধুদের চিন্তার বিষয়। উল্লেখ্য, একবার আইসিসির সদস্য হয়ে গেলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা যায় কি না, তা তদন্তের জন্য সংস্থাটির প্রতি অনুরোধ জানাতে পারবে ফিলিস্তিন। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, পশ্চিম তীর ও গাজায় ২০০৮-০৯ ও ২০১২ সালে ইসরায়েলি সামরিক তৎপরতাকে এ তদন্তের আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবারই জানিয়েছে, দ্রুত এমন কোনো আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত তাদের নেই। তবে এ সুযোগটি ব্যবহার করার সম্ভাবনা যে নেই, তা-ও নয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৮ সালের শেষ থেকে ২০০৯ সালে শুরুর দিক পর্যন্ত গাজায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড, সম্পদহানি ঘটানোর অব্যবহিত পরে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের তদন্ত করার জন্য আইসিসির প্রতি অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। আইসিসির বক্তব্য হচ্ছে, জাতিসংঘ বা আইসিসির সদস্যরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে তাদের কিছু করার উপায় নেই। এবার সে বাধা অতিক্রম হলো। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নানা সীমাবদ্ধতা আছে, টানাপোড়েন আছে। হাতে উপায় চলে আসার পর এবার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইসিসির কাছে আদৌ যাওয়া হবে কি না, গেলে কবে নাগাদ, সেসব প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া আইসিসির সদস্য পাওয়াটাও লম্বা সময়ের ব্যাপার। সদস্যপদ পাওয়ার পরে আবেদন করলে আইসিসি কত দিনে সাড়া দেবে, তারও কোনো ঠিক নেই। অনেক ‘যদি’ অনেক ‘কিন্তু’র পরেও ফিলিস্তিন যদি যুদ্ধাপরাধ-মানবাধিকারের ইস্যু ধরে ভবিষ্যতে এগোতে চায়, তাহলে আইসিসিকে তা গুরুত্বের সঙ্গেই নিতে হবে।
সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের আরেকটি গুরুত্ব আছে। বৃহস্পতিবার আরেকবার প্রমাণিত হলো যে আজকাল আর বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদামাফিক যেকোনো ইস্যুতেই ‘জি হুজুর’ নীতি অনুসরণ করছে না। এটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে দোরগোড়ায় এনে দিয়েছে, এটা কোনোভাবেই বলা চলে না। তবে সিদ্ধান্তটির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুখে যে কিছুটা ঝামা ঘষা হয়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া আশা করা যায়, সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তে পরে, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী আগুন বাড়িয়ে ভোট জেতার যে কায়দা ইসরায়েলের ক্ষমতাসীনেরা অনুশীলন করছে, তাতে ভাটা পড়বে। এতে করে ইসরায়েলি উদারনীতিক ও বামপন্থীদের জন্য কিছুটা স্পেস তৈরি হবে। ফিলিস্তিনিদের দিকে লাভবান হবেন মাহমুদ আব্বাস। কিছুদিন ধরে ম্রিয়মাণ হতে থাকা আব্বাসের পালে এবার নতুন হাওয়া লাগবে মনে হয়। কেননা, সাধারণ ফিলিস্তিনিদের কাছে জাতিসংঘের স্বীকৃতিলাভকে আব্বাসের কূটনীতির বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া ওয়াশিংটনের চাপের মুখেও সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি থেকে সরে না আসার জন্য তিনি বাহবা পাচ্ছেন। এভাবে এগোলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হইচই কমতে থাকবে এবং উদারনীতিকদের হাতে নেতৃত্বের রশিটি ধরা থাকবে। অবশ্য উদারনীতিক যে রকম ‘উদারভাবে’ আপসকামিতার আশ্রয় মাঝেমধ্যে নিয়ে থাকে, তা অব্যাহত থাকলে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে ভাবা মুশকিল।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.