আসন্ন হলো কি তাঁর সন্ন্যাসযাত্রা by রণজিৎ বিশ্বাস

বহু পুরোনো কথা। তুমি তখন রিটায়ার করবে, যখন মানুষ আফসোস করে বলবে—খেলতে তো পারত সে আরও, দিয়ে তো যাচ্ছিল সে ভালোই, দলকে দেওয়ার তো ছিল তার আরও কিছু; তত দিন তুমি দলে জায়গা জুড়ে থাকবে না, যখন মানুষ বিরক্ত হয়ে বলবে—যায় না কেন এখনো সে!
আর কত! কত আর সে দলের কাঁধে ভার চাপিয়ে বসে থাকবে!
মুম্বাই টেস্টে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় বাকি থাকতে ভারতের ১০ উইকেটের পরাজয়ের পর শচীন টেন্ডুলকার এই কথা মনে করিয়ে দিলেন। ৩৯ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার অনেক রেকর্ড নিজের নামের পাশে জড়ো করার পরও মুম্বাই-পরাজয়ের পর তাঁর দিকেই যে সমালোচনার তির সার বেঁধে ছুটে আসছে এবং তাঁর দিকেই যে শাসনাঙ্গুলি বেশি উঠছে, তার কারণ আছে। কারণগুলো জোরালো।
আহমেদাবাদের প্রথম ইনিংসে তিনি তেমন কিছুই করতে পারেননি। ১০ ছাড়িয়ে কদম-দুকদম গেছেন কি যাননি, অসহায়ের মতো বলে বসলেন, ‘এবার আমি মরে যাব।’ ‘কথা’ তিনি রাখলেনও। ৯ উইকেটে ভারতের জয় হলো বলে দ্বিতীয় ইনিংসের পরীক্ষা থেকে তিনি পার পেয়ে গেলেন।
দ্বিতীয় টেস্টে, নিজের আঙিনা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে, দ্বিতীয় ইনিংসে, দল যখন তাঁর রানের জন্য কাঁদছিল, তখন ইংল্যান্ডের বাঁহাতি স্পিনার মন্টি পানেসারের ফুলার লেংথ ডেলিভারি মিস করলেন এবং এলবিডব্লু হলেন। সংগ্রহ ৮। একই স্কোরে একই বোলারের হাতে প্রথম ইনিংসেও প্রাণ দিলেন।
মুম্বাইয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে গৌতম গম্ভীরই শুধু ১৪২ বল খেলতে পেরেছিলেন ৬৫ রানের জন্য। আর কেউ না খেলেছেন, না খেলতে পেরেছেন।
তবু শচীন ‘শচীন’ বলেই এবং বহুদিন ধরে তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই আর সবার ব্যর্থতা ছাড়িয়ে ও ছাপিয়ে তিনি বিশ্লেষক সমালোচনার তাতিয়ে তুলেছেন।
পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ওঁর মতো একজন শিল্পী অত দিন ধরে ক্রিকেটের ফ্রেমে অমন বিবর্ণ ছবি আঁকতে পারেন না। কত দিন ধরে তাঁর ব্যাটের তুলি এমন করছে। ১০ টেস্ট। এই ১০ টেস্টে একটিই তাঁর ফিফটি।
২৩ বছরের ক্যারিয়ারে অচিনপুরে তিনি অনেকবার ঢুকেছেন। কিন্তু বেরিয়ে আসতে এতটা সময় আগে কখনো নেননি।
এবার নেওয়ার পর কথা বড় বেশি হচ্ছে, কারণ ব্যাট হাতে কিছুতেই তাঁকে মজবুত মনে হচ্ছে না। আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি তাঁকে ছেড়ে যেতে যেতে একেবারেই প্রায় দেউলিয়া করে ছেড়েছে।
তার পরও ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা রাজীব শুক্লা বলছেন—শচীনকে উপদেশ দেওয়ার কিছু নেই। সমালোচনা করার আগে তাঁর বিশাল যত রেকর্ড, সেগুলোর বিষয়ে ভাবনছুট ও স্মৃতিছুট হওয়া চলবে না। তিনি প্রবলভাবে ফিরে আসবেন। নিজের বুটজোড়া তিনি তখনই ঝুলিয়ে রাখবেন, যখন তিনি মনে করবেন—এবার যাওয়া উচিত।
‘যাওয়া তার উচিত’ এমন কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এক টিভি চ্যানেলে সুনীল গাভাস্কার বলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত হোম সিরিজে শচীনকে চেনামানুষ মনে না হওয়ার পর, ‘ওর এখন উচিত সিলেক্টরদের সঙ্গে বসা।’
কোনো কিছুই যে শচীন গায়ে মাখছেন না, তার প্রমাণও তিনি দিয়ে চলেছেন। খুব ভারী এক পাথরচাপা পরাজয়ের পরও তিনি ভালো ঘুমিয়েছেন এবং পরদিনই এখনকার দলে ভারতের সেরা প্রজ্ঞান ওঝাকে নিয়ে অনেকক্ষণ নেট প্র্যাকটিস করেন এবং কোচ ডানকান ফ্লেচারকে সঙ্গে রাখেন।
সংবাদের শেষ কথা হচ্ছে, ৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু কলকাতা টেস্টেও শচীন খেলবেন। কী আছে তাঁর মনে, তাঁর চেয়ে ভালো কেউ জানে না। অনুমান, তিনি হয়তো চাইছেন একটা ভালো ইনিংস খেলে মাঠ থেকেই বিদায় নেবেন, যেমন নিয়েছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল।
কিন্তু, ভালো একটা ইনিংসের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে আরও কটা ইনিংস তিনি অন্য রকম খেলে ফেলেন, তার পর্যবেক্ষণ শেষবারের মতো শুরু হচ্ছে কলকাতা থেকে। ক্রিকেট-কল্লোলে কম্পমান কলকাতার ইডেন গার্ডেনই বলে দেবে আর কত দূর তাঁর সন্ন্যাসযাত্রা অথবা কখন হবে ক্রিকেটসংসার ছেড়ে তাঁর বানপ্রস্থ গমন।
এসব দেখতে অথবা এমন সব কথা এমন করে বলতে আমাদের ভালো লাগছে না। তার পরও দেখতে হচ্ছে, তার পরও বলতে হচ্ছে।
[আগ্রা, ২৯ নভেম্বর।]

No comments

Powered by Blogger.