স্মরণ- সেই পরিবেশবাদী by শামীমা জামান

ড. মোহিউদ্দিন ফারুক ছিলেন একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, গবেষক, পরিবেশকর্মী এবং আইনবিদ। তিনি সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও প্রথাগত আইনি পেশাকে বেছে না নিয়ে তিনি আইন পেশায় যোগ করেন এক নতুন মাত্রা।
প্রগতিশীল মনন থেকে তিনি পরিবেশসংক্রান্ত আইনকে জনস্বার্থে ব্যবহারের শপথ নিয়ে ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এ দেশের লাখো-কোটি মানুষের অনেকেই যে বিষয়টি জ্ঞাত নন তা হলো, মোহিউদ্দিন ফারুকের কল্যাণে আজ তাঁরা এমন কিছু সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারেন, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিল না। একটি কোম্পানির উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয় গুঁড়া দুধ আমদানির বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে মোহিউদ্দিন ফারুক যে মামলা করেছিলেন, সে মামলার মাধ্যমে এ দেশের মানুষের জীবনের অধিকার, পরিবেশের অধিকারের অংশ হিসেবে আদালত কর্তৃক ঘোষিত যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে স্বীকৃতি পায়। তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফলস্বরূপ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক কালজয়ী রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের আলোকে ‘সংক্ষুব্ধ’ বা এর সংজ্ঞাসংক্রান্ত প্রশ্নের সমাধান প্রদান করে প্রায় সিকি শতাব্দীর বিদ্যমান জটিলতা ও বাধানিষেধ দূর করেন। এ রায়ের ফলে বা জনস্বার্থে মামলা করার অধিকার অর্জন করেছে আজ এ দেশের মানুষ।
কত কী নিয়েই না লড়াই করেছেন মোহিউদ্দিন ফারুক। ফ্যাপ-বিরোধী আন্দোলনে তাঁকে দেখা গেছে সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছাকাছি থেকে তাদের দাবি, তাদের ভাষাকে আইনের ভাষায় রূপ দিতে।
১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। অতি নগণ্য একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের সব চিকিৎসক একযোগে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। হাসপাতালগুলোতে শুরু হয়েছিল নৈরাজ্য। একেকটা হাসপাতালে শত শত রোগী মারা গিয়েছিল বিনা চিকিৎসায়। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ হাসপাতালে এসে ভিড় জমাচ্ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত মানুষ হাসপাতালে এসে মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করছিল। চিকিৎসকেরা সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এসব ভাগ্যহত মানুষকে জিম্মি করে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের ঘৃণ্যতম পথ বেছে নিয়েছিল। নিপীড়িত সেই অবস্থার কথা ভেবে মোহিউদ্দিন ফারুক সর্বাত্মক চিকিৎসক ধর্মঘট চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। এ ধর্মঘটকে অবৈধ বলে দাবি করেছিলেন। হাইকোর্ট থেকে জনস্বার্থে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্তভাবে চিকিৎসকদের অবৈধ ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সেদিন। দুস্থ, নিপীড়িত, চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশী শিশু-বৃদ্ধ-যুবক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। হাইকোর্টের সেই নির্দেশের পর এ দেশের চিকিৎসকেরা আর কখনো এমন ঘৃণ্য পথে পা বাড়াতে সাহস পাননি।
বাংলাদেশ থেকে শিশু পাচার করে উটের জকি হিসেবে ব্যবহার করে একটা বর্বর উন্মত্ততায় বিভিন্ন আরব দেশ মেতে ওঠে। এই ছোট শিশুগুলোর ওজন কম, তাদের পিঠে ওঠালে হালকা বলে দৌড়াতে সুবিধা হয় এবং শিশু ভয়ে কাঁদতে থাকলে উট দ্রুত দৌড়াতে থাকে। মোহিউদ্দিন ফারুক মামলা করে জানতে চেয়েছিলেন, কতজন শিশুকে পাচার করা হয়েছে এবং তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য কী করা হয়েছে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। বহু পুরোনো আইন সক্রিয় করার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। আইন বিভাগে পরিবেশবিজ্ঞান কোর্স মাস্টার্স প্রবর্তন করা হয়েছে, এটা মোহিউদ্দিন ফারুকের কাজের জন্যই সম্ভব হয়েছে। পরিবেশ নিয়ে সবাই এখন ভাবছে। শুরুটা করেছিলেন মোহিউদ্দিন ফারুক।
১৯৫৪ সালের ২৫ জুন গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, মা আনোয়ারা আহমেদ।
১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ থেকে এলএলবি (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৯ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানসহ এলএলএম পাস করেন। নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ থেকে ১৯৮১ সালে প্রথম বিভাগে ডিপ্লোমা অর্জনের কৃতিত্ব লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৮১ সালে পার্লামেন্টারি ফেলোশিপ অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিপ্লোমা ইন ইন্টারন্যাশনাল ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে সার্বিক নৈরাজ্যজনক অবস্থা আর সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা ভেবেই তিনি আইনের উৎকর্ষ সাধনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আইনবিশারদ মোহিউদ্দিন ফারুক পরিবেশবাদী লেখক হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সাতটি গ্রন্থসহ ৬৯টি প্রকাশনা রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকায় তাঁর বহু লেখা ছাপা হয়েছে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তিনি বহু নিবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহু পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।
মোহিউদ্দিন ফারুক ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সমাজের ব্যাধি নির্মূল করার ব্রত নিয়ে যিনি নিবেদিত ছিলেন, নিজের শরীরের ব্যাধির কাছে তিনি পরাস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু পরাস্ত হয়নি তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বেলা। মৃত্যুর কয় দিন আগে যে সুযোগ্য তরুণীর হাতে সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ‘বেলা’কে, তিনি আজকের নারীদের গর্ব সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ২০০৯ সালে রিজওয়ানা হাসান জাতিসংঘ গোল্ডম্যান পুরস্কারে ভূষিত হন আর এ বছর তাঁর ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রমাণ করে, মোহিউদ্দিন ফারুকের অসমাপ্ত কাজকে রিজওয়ানা হাসান কী নিপুণভাবে সম্পন্ন করে চলেছেন।
শামীমা জামান

No comments

Powered by Blogger.