পার্বত্য চুক্তি- দেড় যুগ পরও প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি! by ইলিরা দেওয়ান

১৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী বান্দরবানের রুমা ও থানচির দুটি সেতু উদ্বোধন করে এলেন। সেতু দুটি রুমা-থানচিবাসীর জীবনমানে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর রুমা-থানচিবাসীর এ আবেগকে পুঁজি করে প্রধানমন্ত্রী নৌকার পক্ষে ভোট চাইতেও ভোলেননি।
পাহাড়ের মূর্খ (!) জনগণের সামনে মুলা ঝোলানোর জন্য এর চেয়ে মোক্ষম সময় ও অস্ত্র ছাড়া বর্তমান সরকারের হাতে আর যে অন্য কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী বরাবরের মতো এবারও পাহাড়বাসীকে আশ্বাস দিয়েছেন, চুক্তি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে!
চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি এ পর্যন্ত মাত্র চারবার বৈঠকে বসেছে। ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর খাগড়াছড়িতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সভায় চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলোর একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকার কোন বিষয়গুলো বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করেছে, তা সাধারণ জনগণের কাছে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। গত ২ অক্টোবর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) কর্তৃক আয়োজিত ‘সিএইচটি-রিভিজিটিং দ্য পিস অ্যাকর্ড’ শীর্ষক এক সেমিনারে সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক রকম পলিটিকস ঢুকে গেছে...আগে পাহাড়িরা ভালো ছিল, তেমন কিছু বুঝত না। তাদের টাকা দিয়ে বিদেশিরা প্রলোভন দেখাচ্ছে। আসলে পাহাড়ে রাস্তা করে বিপদ হয়েছে’ (প্রথম আলো, ৩ অক্টোবর ২০১২)। চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব যাঁর ওপর বেশি বর্তায়, তিনি যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে বিপদের আশঙ্কায় ভোগেন, তাহলে পার্বত্যবাসী কার ওপর আস্থা রাখবে!
সম্প্রতি বেশ ঘটা করে পাঁচটি সরকারি সংস্থাকে পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের বাগাড়ম্বর দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, অনেক কিছুই বুঝি হস্তান্তরিত হয়েছে! চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। বর্তমান সরকার চুক্তি মোতাবেক কয়েকটি কমিটির পুনর্গঠন, ৩৫টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ও একটি ব্রিগেড পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০ প্রণয়ন করেছে বটে, কিন্তু চুক্তির কিছু মৌলিক বিষয় যেমন—আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন, পরিবেশ, পর্যটন—সেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনো হস্তান্তর হয়নি। গত জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় ৩০ আগস্ট, ২০১২ সালের মধ্যে অহস্তান্তরিত বিষয়গুলো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও, অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় হস্তান্তর করে পার্বত্য জনগণের কাছে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার নমুনা দেখানোর একটি উপলক্ষ তৈরি করা হয়েছিল মাত্র।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পার্বত্য চুক্তি পুনর্বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলেও পরে এটি আর অগ্রাধিকার পায়নি। ‘দেশে কোনো আদিবাসী নেই’—এ প্রচারণা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকৃতি, বিভিন্ন সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনে নিষেধাজ্ঞা, বাধাদান ইত্যাদিতে সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত। অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনানিবাস সম্প্রসারণ, বিজিবির হেডকোয়ার্টার্স স্থাপন ও ক্যাম্পের পরিধি বৃদ্ধিকরণ, ইকোপার্ক, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ, এতে শত শত পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে, বেআইনিভাবে হাজার হাজার একর ভূমি ইজারা প্রদান করা হচ্ছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও চুক্তি স্বাক্ষরের দেড় যুগ পর এখনো পাহাড়বাসীর চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
একদিকে প্রধানমন্ত্রী চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার বিভিন্ন দপ্তরে এক গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা’র পরিবর্তে ‘খাগড়াছড়ি’ লেখার নির্দেশনা প্রদান করা হয় (সমকাল, ১৯ নভেম্বর ২০১২)। অথচ ১৯৮৯ সালের জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮, ভূমি কমিশন আইন, ২০০১-সহ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক বিভিন্ন আইনে ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের এ গোপনীয় তৎপরতায় একদিকে যেমন পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘিত হচ্ছে, অন্যদিকে এ অপচেষ্টার মাধ্যমে পাহাড়ে আবার নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রমের ওপর সরকারের বিশেষ সংস্থার পক্ষ থেকে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর এনজিওগুলোর তালিকা ও তাদের কার্যক্রমের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে ‘সরকারের বিশেষ সংস্থার মন্তব্য’ নামের একটি কলাম আছে। এ কলামের মন্তব্যগুলো চরম সাম্প্রদায়িক এবং উল্লিখিত এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ একটাই অভিযোগ, তা হচ্ছে, ‘শান্তিচুক্তি’ বাস্তবায়নের জন্য তারা কাজ করছে! তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থক! তারা উপজাতীয় (!) সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করছে! সরকার পাহাড়িদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও কেন তারা ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করে এনজিও ব্যুরো থেকে রেজিস্ট্রেশন (১৯৯৯) নিয়েছে, ইত্যাদি কারণ উল্লেখ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য এনজিওগুলোর কোনোটির নিবন্ধন বাতিলের, আবার কোনোটির অনুদান বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি, আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল। বর্তমানে ক্ষমতায় আসার আগেও আওয়ামী লীগ পার্বত্য চুক্তি পুনর্বাস্তবায়নের কথা বলেছিল এবং এখনো বাস্তবায়নের কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন বা বিশেষ সংস্থাগুলো যেভাবে সরকারের এ কাজের বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এতে এটি স্পষ্ট যে সরষের মধ্যেও ভূত আছে!
আমরা আগেও বলেছি এখনো বলছি, আর প্রতিশ্রুতি নয়। এ বছর পার্বত্য চুক্তির দেড় যুগ পূর্তি, অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। এবার প্রবঞ্চনার প্রতিদানের সময় হয়েছে! পার্বত্য সমস্যার অন্যতম দিক ভূমি বিরোধ। শুধু কমিশন গঠন করেই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির দায় এড়ানো যাবে না। ২০১১ সালের ২০ জুন ভূমি কমিশন আইনে যে ১৩ দফা সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো আজ অবধি সংসদে উত্থাপনের উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। তদুপরি এখন ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান পদটিও শূন্য। একটি কথা মনে রাখতে হবে, গত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবার আর ধোপে টিকবে না। তাই যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়টি সামনের সারিতে আনতে হবে। নতুবা পাহাড়বাসীর মনের খবর জানতে আমাদের আগামী নির্বাচনী ফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
ilira.dewan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.