চরাচর-পাহাড়ি জলধারা by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

'তুমি ঝরনা, জীবনস্রোতে তুমি যে কেবল চলছ তা নয়, তোমার চলার সঙ্গে সঙ্গেই তোমার বলা। সংসারের যে-সব কঠিন অচল পাথরগুলোর উপর দিয়ে চলো তারাও তোমার সংঘাতে সুরে বেজে ওঠে।...' শেষের কবিতায় এভাবেই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। পাহাড়, টিলা আর চা-বাগান ঘেরা চিরসবুজের আবাসস্থলের নাম শ্রীমঙ্গল।


প্রকৃতি এখানে নানা বৈচিত্র্যে রাঙা। পাকা সড়কের দুই পাশের ঘন সবুজ চা-পাতার দিকে চোখ ফেরালেই মন আনন্দে ভরে যায়। বর্ষা মৌসুমে চা-জনপদের এই ভেজা ভেজা দৃশ্য আরো মনোরম হয়ে ওঠে। শান্তি-সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে এখানে ঝিরঝির-শিরশির ছন্দে অবিরাম বইছে অসংখ্য ছড়া। এগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছে অনেক পাহাড়ি জনবসতি। ভারত থেকে আসা এ ছড়াগুলো পাহাড়ি মানুষের হাসি-কান্না, হতাশা-বঞ্চনা, দুঃখ-দারিদ্র্যের নানা কথা নীরবে দূর থেকে বয়ে নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট বালুখেকোদের ক্রমাগত দৌরাত্ম্য শ্রীমঙ্গলের অসংখ্য পাহাড়ি ছড়াকে আজ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। জরাজীর্ণ হয়ে যে অবশিষ্ট ছড়াগুলো কোনোমতে বেঁচে আছে, সেখানেও পয়োনিষ্কাশনসহ বিভিন্ন কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ছড়া ঘিরে বেঁচে থাকা ছোট ছোট প্রাণীও আজ বিপন্ন।
আকাশের বুক চিরে নেমে আসা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির নির্মল পরশ যেন হঠাৎই জাগরণের গান শোনায় প্রতিটি ছড়ার কানে কানে। অশান্ত বর্ষণ ছড়ার দীর্ঘদিনের আড়ষ্ট ও জীর্ণতাকে মুছে ফেলে নতুনভাবে প্রাণদান করে। জলধারার কলস্বরে নেমে আসে বর্ষা প্রকৃতির গভীর গোপন সজীবতা। চারদিকে স্বচ্ছ জলধারার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। প্রকৃতির এই অদ্ভুত সৌন্দর্যে মিলিয়ে যেতে মন আকুল হয় বারবার। এখানকার চা-বাগান ঘেরা প্রকৃতি বর্ষায় যেন তার শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে পায় নতুনভাবে। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কিংবা রাত যেন প্রতিটি ভালো লাগার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয়।
সবুজ পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে কলকল শব্দে বয়ে গেছে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া। উজানে পাহাড়ি ঢল দ্রুত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে আবার ফিরে যায় উপ-নদী, ছড়া-ঝিরি হয়ে হাইল হাওরে। মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত হাইল হাওর। এ হাওরটিকে একসময় বলা হতো বৃহত্তর সিলেটের মৎস্যভাণ্ডার। হাওরটি শুকনো মৌসুমে চার হাজার হেক্টর হলেও বর্ষায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের আবকান পাহাড়ের এক প্রান্তে বিশাল ভূমিকম্পের ফলেই হাইল হাওরের সৃষ্টি হয়। এক দশক আগেও শতাধিক পাহাড়ি ছড়া গিয়ে হাইল হাওরে পতিত হতো। আর এতে প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যে প্রাণের সঞ্চার হতো। ফুলছড়া, জাগছড়া, জানকিছড়া, নারায়ণছড়া, উদনাছড়া, বৌলাছড়া, খাইছড়া, গোপলাছড়া, ভুরভুরিয়াছড়া, বিলাশছড়াসহ ২০-২৫টি ছড়া বর্তমানে জীবিত রয়েছে। বেশির ভাগ ছড়ার মাটি খুঁড়ে বালু উত্তোলনসহ পরিবেশ ধ্বংসের নানা অপঘাতে ছড়াগুলো মৃত্যুবরণ করছে গোপনে।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.