ফলোআপ-ছাত্রলীগের নামে পুরান ঢাকায় চাঁদা তুলছে ম্যাগনেট বাহিনী by আপেল মাহমুদ

কালের কণ্ঠে গত ১০ আগস্ট 'চাকা ঘুরলেই চাঁদা দিতে হয় হলার মালিকদের' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ম্যাগনেট বাহিনী আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা আগের চেয়ে বেশি চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেছেন হলার মালিকরা। তাঁদের অসহায়ত্ত আরো বেড়েছে।


নিয়মিত চাঁদার বাইরেও তাঁদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গাড়ির মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, গতকাল ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠানের কথা বলে হলার মালিকদের কাছ থেকে ম্যাগনেট সালাম ও ধলা ফারুক এক লাখ টাকা চাঁদা তুলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নামে। তবে ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এক লাখ টাকা নয়, ৪০-৫০ হাজার টাকা হলারস্ট্যান্ড থেকে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর হলার মালিকদের অনেকেই কালের কণ্ঠ অফিসে যোগাযোগ করে বলেছেন, ম্যাগনেট বাহিনী মূলত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষকতায় চাঁদাবাজি করছে। একসময় ডাকাত শহীদের নাম বলে তারা নিরীহ হলার মালিকদের হুমকি দিয়ে চাঁদাবাজি করত। এখন করে ছাত্রলীগের নামে। প্রশাসন এ কারণেই চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অবশ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দ কালের কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি হলারস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। কিন্তু হলার মালিকরা তাঁর এই বক্তব্য সঠিক নয় উল্লেখ করে বলেন, জড়িত না থাকলে ম্যাগনেট বাহিনীর বিরুদ্ধে কেন তাঁরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি মাসের ২ তারিখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে অতিথি ছিলেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সাতজন যুগ্ম আহ্বায়ক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিতভাবে আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দের অপসারণ দাবি করেন। এ ব্যাপারে সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দের অপসারণ নয়, তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো যাতে ছাত্রলীগের ঐক্য নষ্ট করতে না পারে, সে কথা হয়েছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ আহ্বায়ক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আরিফুজ্জামান লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
অতীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নামে হলারস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজি নিয়ে মারামারি, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছিল বলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। লিয়াকত এভিনিউয়ের ব্যবসায়ী হরিপদ দাস বলেন, অতীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের নামে প্রতিদিন হলারপ্রতি ২৫০ টাকা করে চাঁদা তুলতেন ম্যাগনেট সালাম এবং ধলা ফারুক। নানা কারণে ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের এ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এর পরও তাঁরা চাঁদা তোলা অব্যাহত রাখেন। এর ফলে কামরুল হাসান রিপনের বন্ধু সোহেল রানা ওরফে রগ সোহেল চাঁদাবাজ ধলা ফারুককে মারধর করেন। ম্যাগনেট সালাম পালিয়ে গিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পান।
২০১১ সালের ৯ জুন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক কমিটি গঠন হওয়ার পর আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দের নামে ম্যাগনেট বাহিনীর লোকজন হলার থেকে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি শুরু করে। তারা প্রতিটি হলার থেকে ২৫০ টাকা করে চাঁদা তুলছে বলে হলার মালিকরা অভিযোগ করেন। এ হিসাবে ১১০টি হলার থেকে প্রতিদিন চাঁদা উঠছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা, যা মাসে দাঁড়ায় ৯ লাখ টাকা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক নাম প্রকাশ না করে বলেন, তাঁদের নামে চাঁদাবাজির কথা তিনি জানেন না। তবে কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠান থাকলে হলারস্ট্যান্ড থেকে কিছু চাঁদা পান বলে জানান। ছাত্রলীগের আহ্বায়ক বা অন্য কোনো নেতা হয়ত এ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।
হলার মালিকরা জানান, তাঁদের কাছে একসময় আতঙ্ক ছিল ডাকাত শহীদ। তার নামে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা দিতে হতো। ডাকাত শহীদের মৃত্যুর পর তা বন্ধ হলেও ছাত্রলীগের নামে একইভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে ম্যাগনেট বাহিনী। হলারস্ট্যান্ড থেকে ডাকাত শহীদের নামে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে ধলা ফারুক লিখিত এক প্রতিবাদপত্রে বলেছেন, 'ডাকাত শহীদ জীবিত থাকা অবস্থায় তার সহযোগীরা প্রতি মাসে বড় অঙ্কের টাকা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেত।' হলার মালিকরা জানান, যার নামেই চাঁদা তোলা হোক, ম্যাগনেট বাহিনী সে টাকার বিরাট একটি অংশ হাতিয়ে নিচ্ছে।
হলার মালিক গনি ও কিরণ জানান, বাহাদুর শাহ পরিবহন মালিক সমিতির স্বঘোষিত সভাপতি ম্যাগনেট সালাম এবং সাধারণ সম্পাদক ধলা ফারুক স্ট্যান্ডের কর্তৃত্ব নেওয়ার সময় তাঁদের কিছুই ছিল না। কিছু দিনের মধ্যে তাঁরা অনেক টাকা মালিক হয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা তিনটি হলারের মালিক বলে দাবি করছেন। তাঁরা লিখিত প্রতিবাদপত্রে বলেছেন, তাঁরা ১১-০৮০৬, ১৪-০৩৮৪ ও ১১-০৯০৮ নম্বর হলারের মালিক। কিন্তু উক্ত গাড়ির কাগজপত্রে তাঁদের কোনো নাম নেই। অন্যের গাড়ি নিজের নামে পরিচালনা করছেন বলে হলারস্ট্যান্ড সূত্রে জানা গেছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজির জন্যই তাঁদের প্রবেশ পথের ২ নম্বর ফটকটি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফলে অনেকটা পথ ঘুরে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে হয়। ফটকটি খুলে দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বরাবর একাধিকবার লিখিত আবেদন জানালেও রহস্যজনক কারণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁদের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চাঁদাবাজ চক্রের কারসাজির কারণেই অবরুদ্ধ থাকতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রক্টর অশোক কুমার সাহা বলেন, হলার স্ট্যান্ডটি সরানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে থানা ও ট্রাফিক পুলিশের সভা হয়েছে। ওই সভায় শুধু হলারস্ট্যান্ড নয়, বাহাদুর শাহ পার্ক-সংলগ্ন বাস ও টেম্পো স্ট্যান্ড সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না।
প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ : কালের কণ্ঠে গত ১০ আগস্ট প্রকাশিত 'চাকা ঘুরলেই চাঁদা দিতে হয় হলার মালিকদের' শীর্ষক প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করেছেন ঢাকা জিলা যানবাহন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক হোসেন। প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য মিথ্যা, বানোয়াট আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, বাহাদুর শাহ পরিবহনে মোট ১০৮টি হলার আছে। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশ গাড়ি পুলিশ রিকুইজিশন ও মেরামতের জন্য বসে থাকে। তিনি বলেন, 'প্রতিবেদনে আমাদের ডাকাত শহীদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ডাকাত শহীদ জীবিত থাকতে হলারস্ট্যান্ড থেকে তার নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা যেত। তার মৃত্যুর পর স্ট্যান্ডে আনন্দ প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।'
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হলে ৪০ জন হলার মালিক সেখানে পরিবহন মালিক মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরে গিয়ে এ অভিযোগ মিথ্যা বলে সাক্ষ দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয়, হলার গাড়ি নিয়ে কোনো চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তা ছাড়া তাঁদের নাম বিকৃত করে প্রকাশ করায় তাঁরা সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মো. ফারুক হোসেন তাঁর প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করেন।
প্রতিবেদকের বক্তব্য : অভিযোগকারী, ক্ষতিগ্রস্ত হলার মালিক এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে প্রতিবেদকের কোনো মতামত নেই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো তথ্য উত্থাপিত হয়নি। হলার মালিকরা যে চাঁদা দেন, তা লিখিতভাবে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তা ছাড়া লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের বরাবর দেওয়া ৩৬ জন হলার মালিকের অভিযোগপত্রে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় ধলা ফারুক হলার থেকে চাঁদা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, যার প্রমাণ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.