মাঠে দাম নেই, সরকারি পাটকলগুলো আবারও লোকসানে, উৎপাদন ও রপ্তানি আয় দুটোই কমছে -আবার পাটের দুর্দিন by ইফতেখার মাহমুদ

আবারও পাট খাতের দুর্দিন শুরু হয়েছে। এ খাতে কিছুটা আলোর ঝলকানি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার অন্ধকারের ঘনঘটা। পাটের দাম থেকে শুরু করে উৎপাদন, রপ্তানি আয় ও অভ্যন্তরীণ বাজার— সবকিছুতেই মন্দা ভাব।


এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই সারা দেশে সোনালি পাট মাঠ থেকে হাটে উঠছে। চাষি, ব্যবসায়ী বা পাটকল মালিক—সবাই হতাশ। সব মিলিয়ে পাটের সোনালি দিন আবারও ঝাপসা হতে শুরু করেছে।
দুই বছর ধরে ক্রমাগত লোকসানে ক্লান্ত কৃষক এবারও পাট নিয়ে বিপদে পড়েছেন। ভালো নেই পাট ব্যবসায়ী ও পাটকলের মালিকেরাও। দেশে-বিদেশে পাট বিক্রি কমে গেছে। সরকারি পাটকলগুলো নতুন করে লোকসানের মুখে পড়েছে। দুই বছর ধরে লোকসানের জেরে এ বছর চাষিরা পাট চাষ কমিয়ে দিয়েছেন।
দেশের বেশির ভাগ এলাকায় পাট কাটা শেষ। বৃষ্টি কম হওয়ায় চাষিরা এমনিতেই পানির অভাবে পাট পচাতে পারছেন না। তার ওপর যোগ হয়েছে পানির দরে পাট বিক্রির বেদনা। দেশের বড় হাটগুলোতে পাট আসতে শুরু করেছে। আবার গত বছর বিক্রি না হওয়া বিপুল পরিমাণ পাটও রয়ে গেছে। ফলে দাম নিয়মিতভাবে কমছে। সার, জ্বালানি তেল ও কৃষির মজুরি বাড়ায় পাটের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। এতে পাট বেচে উৎপাদন খরচ তোলাই চাষিদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে।
গত বছর এর আগের বারের তুলনায় দাম কম হলেও প্রতি মণ উন্নত মানের পাট দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে উন্নত মানের পাট চাষ হয়। এবার এই পাটের দাম দেড় হাজার টাকারও কম। যশোর ও উত্তরাঞ্চলের নিম্নমানের এক মণ পাট ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক তন্তুর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পাটের আন্তর্জাতিক বাজার আরও বিস্তৃত করার সুযোগ ছিল। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে বন্ধ পাটকলগুলো চালু করার মতো রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় উদ্যোগই বেশি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু কাঁচা পাট ও পাটজাত সামান্য কয়েকটি পণ্য নির্দিষ্ট কিছু দেশে রপ্তানি করে, তাই মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ বিপদে পড়েছে।
মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় আকারের পাটকলের চেয়ে বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি করতে পারে, এমন ছোট ও মাঝারি পাটকল বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সরকারের উচিত বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন এবং এর বাজারজাত করার ব্যাপারে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর দেশে সাত লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ৮০ লাখ বেল পাটের উৎপাদন হয়েছিল। এ বছর চাষের জমি এক ধাক্কায় ৬০ হাজার হেক্টর কমে গেছে। উৎপাদনও সাকল্যে ৭০ লাখ বেলের বেশি হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অন্যদিকে, তিন বছর ধরে টানা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ও আয় বেড়েছিল। চলতি বছর রপ্তানি বাজারও মন্দা, আয় কমেছে ১৩ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১১৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে তা ৯৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।
দেশের পাটের দাম নির্ভর করে কাঁচা পাট রপ্তানির ওপর। এক বছর ধরে কাঁচা পাটের রপ্তানিতে ধস নেমেছে। কাঁচা পাট রপ্তানি কমেছে ৩১ শতাংশ।
রপ্তানির তুলনায় অভ্যন্তরীণ পাটের বাজারই বেশি হতাশাজনক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন, ২০১০’ অনুমোদন করে। আইনে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যে ৭৫ শতাংশ পাট আছে, এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু দেশে পাটের ব্যাগের ব্যবহার না বেড়ে বরং কমে গেছে। গত অর্থবছর সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্যের মোড়ক হিসেবে ২৬ হাজার ৫৬০ টন পাট ব্যবহার করেছিল। চলতি বছর তা কমে ১৩ হাজার ৬৫০ টনে নেমে এসেছে।
২০১০-১১ অর্থবছর ১৮টির মধ্যে নয়টি পাটকল লাভ করেছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে এর মধ্যে তিনটি পাটকলে লোকসান হয়। ফলে লোকসানে থাকা পাটকলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২টি।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) হুমায়ুন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের পাটের মূল ক্রেতা মিসর, ইরান, সিরিয়া ও লিবিয়া। রাজনৈতিক সংকটের কারণে এই দেশগুলো পাটের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। তবে সম্প্রতি নতুন কয়েকটি দেশ নতুন করে পাট কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছে। নতুন বাজার পেলে ও মধ্যপ্রাচ্যের সংকট কাটলে পাটের বাজার আবারও চাঙা হবে বলে ব্যবসায়ীরা আশায় আছেন।

No comments

Powered by Blogger.