মহাসড়কে অতিরিক্ত গাড়ি, দীর্ঘ যানজট

ঈদ উপলক্ষে নাড়ির টানে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। মঙ্গলবার রাত থেকেই একসঙ্গে অনেক মানুষ ঢাকা ছাড়ার ফলে মহাসড়কগুলোতে পড়ছে বাড়তি গাড়ির চাপ। একদিকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা ও ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ফলে গতকাল বুধবার ভোর থেকে বিভিন্ন সড়কে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট।


গতকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট ছিল সবচেয়ে বেশি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট : কুমিল্লা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এবার যানজটের কবলে পড়লেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই। যানজটে তিন ঘণ্টা আটকে ছিলেন তিনি। যানজটের জন্য মন্ত্রী কাভার্ড ভ্যানগুলোর দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। এ জন্য তিনি আগামী দুই দিন কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ ও গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দির রায়পুরে দুটি ট্রাক দুর্ঘটনাকবলিত হলে এবং বুড়িচংয়ের কোরপাইয়ে একটি লরি বিকল হলে মহাসড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকেল ৫টা পর্যন্ত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, চান্দিনা ও দাউদকান্দি সেতুর ওপারে সোনারগাঁ পর্যন্ত যানজট লেগে থাকে। ফলে কুমিল্লা ও মুন্সীগঞ্জ জেলার উভয় দিকে ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে যানজটে আটকে পড়া যাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যখন যানজট, তখন এ সড়ক দিয়ে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা ভবনে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে যাচ্ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত যানজটে আটকে থাকেন মন্ত্রী। কোনো উপায় না দেখে কুমিল্লার কোরপাইয়ে যানজটে আটকা মন্ত্রীর গাড়ির বহর মহাসড়ক ছেড়ে নেমে পড়ে চার লেনের কর্দমাক্ত সড়কে। চার লেন মহাসড়কের জন্য যেখানে শুধুমাত্র বালু ফেলা হয়েছে, তাও সব জায়গায় নয়। যেখান দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করার মতো অবস্থাও নেই। কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই, কিছু দূর এগোলেও আবার যানজটে আটকা পড়ে মন্ত্রীর গাড়ি বহর। পরে হাইওয়ে পুলিশ ও মন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে কোনো রকমে মহাসড়কের রং সাইড দিয়ে বিকেল ৩টার দিকে মন্ত্রীকে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার পার করে দেন।
মহাসড়কে ছয় ঘণ্টা আটকে থাকা বাসচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'মন্ত্রী যেখানে যানজটে আটকা- সেখানে আমাদের অবস্থা কী, তা তো বুঝতেই পারছেন। মন্ত্রী নিজে গাড়ি থেকে নেমে যানজট নিরসনের চেষ্টা চালিয়েছেন।'
ফেনী থেকে আসা স্টারলাইন পরিবহনের বাসের চালক সেলিম মিয়া জানান, ফেনী থেকে এসে তিন ঘণ্টা মহাসড়কে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন দিন ধরে এ মহাসড়কে যানজট লেগেই আছে।
যানজট থেকে মুক্ত হয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, মহাসড়কের জন্য এ যানজট না। এলোপাতাড়ি কাভার্ড ভ্যানগুলো চলাচল করে দুর্ঘটনা ঘটায় যানজট লাগে। প্রতিদিন যানজট নেই দাবি করে মন্ত্রী জানান, ঈদে ঘরমুখো মানুষ যাতে স্বস্তিতে বাড়ি যেতে পারে সেজন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, 'মহাসড়কের যানজটে আমার দায় বেশি থাকত, যদি মহাসড়কের কারণে যানজট হতো। এবার কোনো জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক যান চলাচলের জন্য অনুপযুক্ত নয়। সব জায়গাই উপযোগী।'
দাউদকান্দি ও সোনারগাঁ প্রতিনিধি জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁ বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশে কুমিল্লাগামী দুটি বাস বিকল হয়ে পড়লে গজারিয়া উপজেলার ভাটেরচর মেঘনা সেতু থেকে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশের ওসি ইমতেয়াজ আহমেদ জানান, কুমিল্লাগামী বাস দুটি সোনারগাঁ বাসস্ট্যান্ডের কাছে বিকল হলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। হাইওয়ে পুলিশ যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে মেঘনা ও গোমতী সেতু টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মেহবুব কবির জানান, সেতু দুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এর ওপর দিয়ে কোনো যানবাহন যাতে ওভারটেক করতে না পারে এ জন্য সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সোনারগাঁয়ের চৈতি কম্পোজিট মিলের শ্রমিকরা গতকাল সকালে ঈদের ছুটি পাঁচ দিন করার দাবিতে প্রায় এক ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। যানজটে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ ছুটি বৃদ্ধির আশ্বাস দিলে পুলিশ মহাসড়ক থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়। এরপর পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়।
সোনারগাঁও থানার ওসি (তদন্ত) মেসবাহ উদ্দিন জানান, গতকাল ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রচণ্ড যানজট ছিল। ঈদ সামনে রেখে রাস্তায় রয়েছে বাড়তি গাড়ির চাপ। ফলে মেঘনা টোল প্লাজায় টোল নিতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় মেঘনা এলাকায় কিছুটা যানজট হয়েছিল।
ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানজট কম : টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, অন্য বছরগুলোতে ঈদের সময় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে তীব্র যানজট লেগেই থাকত, কিন্তু এবার তেমন যানজট হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু যানজট সৃষ্টি হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা আবার ছেড়ে যাচ্ছে। তবে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে।
হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট কামরুজ্জামান রাজ জানান, এবার ঈদে পর্যায়ক্রমে আগে থেকেই মানুষ বাড়ি ফেরার কারণে রাস্তায় চাপ কিছুটা কমেছে। এ জন্য রাস্তায় একটানা যানজটও হচ্ছে না। তবে মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত গাড়ির চাপ একটু বেশি ছিল। দুপুরের পর আবার স্বাভাবিক হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা বাস-কোচ-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মীর লুৎফর রহমান লালজু বলেন, মঙ্গলবার রাতে মহাসড়কের টাঙ্গাইলের অংশে যানজট ছিল। সকাল ১০টার পর আবার রাস্তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর থেকে কোনো গাড়ি আর আটকা পড়ছে না।
যানজট নিরসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। টহল দিচ্ছে হাইওয়ে পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার গাড়ির চাপ কিছুটা বাড়তে পাড়ে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ঢাকা-পাটুরিয়া সড়কে ৭০টি স্পিডব্রেকার, সৃষ্টি করছে যানজট : মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঢাকা থেকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে এখন সময় লাগছে অন্তত পাঁচ ঘণ্টা। কারণ এ রাস্তায় ৭০টি স্পিডব্রেকারের জন্য অতিরিক্ত সময় লাগছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। সড়ক ও জনপদ বিভাগ ঈদের মধ্যে যানজট নিরসনের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে সড়কের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে উঠেছে।
ঢাকা-পাটুরিয়া সড়কের ৮০ কিলোমিটারে কিছুদিন আগেও স্পিডব্রেকার ছিল ৫৪টি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০টিতে। সড়ক ও জনপদ সূত্রে জানা যায়, এ সড়কের ১১টি বাঁক প্রশস্ত করার সময় প্রতিটি বাঁকে দুটি করে নতুন স্পিডব্রেকার স্থাপন করা হয়েছে। কোনো কোনো বাঁকে দেওয়া হয়েছে নতুন চারটি স্পিডব্রেকার। এসব বাঁকে এসে যানবাহনকে স্পিড কমাতে হচ্ছে। ফলে প্রতিটি স্পিডব্রেকারে সৃষ্টি হচ্ছে লম্বা যানবাহনের সারি।
এ প্রসঙ্গে দূর পাল্লার একাধিক বাসচালক অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আর কোনো মহাসড়কে এত স্পিডব্রেকার নেই। স্পিডব্রেকারের কারণে তাঁদের ৮০ কিলোমিটার সড়ক পার হতে অতিরিক্ত এক ঘণ্টা সময় লাগছে।
এদিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে এরই মধ্যে ব্যাপক হারে যানবাহনের চাপ পড়েছে। গতকাল বিকেল ৪টায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় তিন কিলোমিটার যানবাহনের লাইন পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.