একটি বিদায় সংবর্ধনা এবং কৃষি ও শিক্ষার সম্পর্ক by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

কৃষি ও শিক্ষার মধ্যে এক বা একাধিক সম্পর্ক থাকতেই পারে; তবে এ সম্পর্কের সঙ্গে কারো বিদায় সংবর্ধনার যোগসূত্র কী হতে পারে, তা নিয়ে পাঠকদের যে কেউ বড় ধরনের প্রশ্ন তুলতেও পারেন। আসলে দুটি বিষয়ই আলাদা। কোনো এক ঘটনাচক্রে আমি তাঁদের এক লাইনে নিয়ে এসেছি।


আমার এ কাজটি যুক্তিসংগত হয়েছে কি না, সেটা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। লেখক হিসেবে রহস্যের জট খোলার দায়িত্বটা নিঃসন্দেহে আমার ওপরই বর্তায়। এখন কথা হলো, বিষয়টি খোলাসা করতে শুরুটা করব কোত্থেকে। শুরু থেকে, না শেষ থেকে। শেষ অংশ সম্পর্কে আমার যা ভাবনা, এর ক্ষেত্র বাংলাদেশ এবং শুরুর অংশ ঘটেছে ১২ হাজার মাইল দূরে আটলান্টিকের ওপারে মার্কিন মুলুকে। যেখান থেকেই শুরু করি, আমি একইভাবে আমার মূল লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব বলেই বিশ্বাস। তাই শুরু করি দেশমাতৃকা বাংলাদেশ থেকেই।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার বড় মুখে দাবি করে থাকে, দেশবাসীর জন্য তারা কৃষি ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য বয়ে এনেছে। ইদানীং তারা যেভাবে সাফল্যের ঢাকঢোল পেটাচ্ছে তাতে মনে হয়, এই দুই মন্ত্রক জাদুর ছোঁয়ায় কৃষি ও শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সঠিক সমাধান করে ফেলেছে। কৃষিমন্ত্রকের কথা অনুযায়ী মনে হয়, কৃষকদের হয়ে গেছে গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ। তাঁদের আর কোনো চিন্তাভাবনা নেই। হাসিমুখে তাঁরা সবাই গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে ভাবখানা এ রকম যে করিৎকর্মা মন্ত্রীর বদৌলতে বিদ্যাশিক্ষায় নৈরাজ্য সব ঘুচে গেছে এবং ছাত্রছাত্রীরা সব নির্বিঘ্নে লেখাপড়া করছে আর শিক্ষক-শিক্ষিকারা সবাই মনের আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। আসল চিত্রটা কিন্তু তা নয়। স্বাভাবিকভাবেই কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। সরকার সার, বীজ ও আনুষঙ্গিক অন্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে তাদের নূ্যনতম দায়িত্বটি পালন করেছে ঠিকই; কৃষকরা বৃষ্টিতে ভিজে এবং রোদে পুড়ে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে অসাধ্য সাধন করেছেন। দেশবাসীকে বাম্পার ফলন উপহার দিয়েছেন। আর এ কাজে আল্লাহর করুণায় প্রকৃতিও সদয় ছিল, তাই এতখানি সফলতা সম্ভব হয়েছে। এতে সরকারের যতটা কৃতিত্ব, এর চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশের কৃষক সমাজ; কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধিই তো কৃষি সমস্যার সব সমাধান নয়। বরং উৎপাদিত পণ্য সময়মতো সঠিকভাবে বাজারজাত করতে না পারলে এটা কৃষকদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। এবার আলু, ধান ও পাটে কৃষকদের উৎপাদন খরচ যা পড়েছে, ওইসব পণ্য বিক্রি করে তারা লাভ তো দূরে থাক, খরচই তুলতে পারছেন না। পণ্যের সঠিক মূল্য না পেয়ে কৃষকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবস্থাপনাটাই ছিল সরকারের আসল দায়িত্ব আর এখানেই সরকার চরমভাবে নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণ করল। শিক্ষাক্ষেত্রে একই অবস্থা। স্কুলে বিনা মূল্যে বই দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি বইগুলো ভুলে ভরা। এসব ভুল নিয়ে বছরের পর বছর বই ছাপা হচ্ছে এবং তা শিক্ষার্থীদের হাতে ওভাবেই তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর কারণ কী, তা আমার বোধগম্য নয়। শিক্ষাঙ্গনে মারামারি, হানাহানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি আজ অতীতের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ছাত্র কর্তৃক শিক্ষকদের অপমান ও মারধরের কথা না হয় নাই বা বললাম। মাত্র সেদিনই তো দেখলাম, গ্রামের শিক্ষকরা তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে জানাতে রাজধানীতে এসেছিলেন, পুলিশের মারধর আর গরম পানির ছিটা খেয়ে তার মধ্যে এক শিক্ষক লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এই তো সরকার বাহাদুরের সাফল্যের নমুনা। তবু বলব, এই দুই মন্ত্রণালয় দাবি করতে পারে যে গেল কয় বছরে তারা অন্তত কিছু একটা করার চেষ্টা করেছে। অন্য মন্ত্রীদের কথা আর নাই বা বললাম। ঘটনাচক্রে এই দুই মন্ত্রকের দায়িত্বে আছেন বামপন্থী দুই মন্ত্রী। তাঁদের সততার একটি সুনাম আছে দেশব্যাপী- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে সেটাও স্বীকার করি, তাঁদের দুজনকে সালাম জানাই। তবে এই দুই মন্ত্রকের সফলতার পেছনে কি কোনো যোগসূত্র আছে, তা আমার জানা নেই।
তবে কৃষির সঙ্গে শিক্ষার যে একটি সম্পর্ক আছে, তা মাত্র সেদিন জানতে পারলাম সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে অন্য এক পরিবেশে। একটি বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গিয়ে আবিষ্কার করলাম এ সম্পর্কের এক নতুন মাত্রা ও তার রহস্য। এবার আসছি এই ঘটনার বর্ণনায়। বিদায় সংবর্ধনাটি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের ল্যান্ড গ্র্যান্ট ইনস্টিটিউটে, অর্থাৎ টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে, যেখানে আমি চাকরি করি ২০ বছর ধরে। এই ইউনিভার্সিটির বিজনেস ফ্যাকাল্টির শিক্ষক ও ডিন ড. টিলডেন কারি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ৪০ বছর। এর মধ্যে তিনি কলেজের ডিন ছিলেন একাধারে ২৭ বছর। আমিই তাঁকে ডিন হিসেবে পেয়েছি ২০ বছর ধরে। তাঁর রিটায়ারমেন্ট উপলক্ষে সেদিন ছিল কলেজের একটি অনাড়ম্বর ও বেদনাবিধুর এক অনন্য বিদায় সংবর্ধনা। এই বিদায় সংবর্ধনার কিছু ঘটনা ও কিছু কথাবার্তা আমার আজকের নিবন্ধের মূল বিষয়বস্তু এবং এখান থেকেই আমি নতুন করে মাত্র সেদিন অনুধাবন করেছি কৃষি ও শিক্ষার এক অভিনব সম্পর্ক।
বিদায় সংবর্ধনায় লোকসমাগম খুব একটা বেশি হয়নি এবং লম্বা লম্বা বক্তৃতা-বিবৃতিও খুব ঝাড়া হয়নি। বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা সংক্ষেপে বিদায়ী ডিনের কাজের মূল্যায়ন করে বক্তব্য রেখেছেন। কেউ কেউ তাঁর বিভিন্ন গুণের কথা বলেছেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহার, সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, কথাবার্তায় ও চিন্তাভাবনায় নতুনত্ব; কিন্তু কাজে ধীরস্থির, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা, সফল লিডারশিপ ইত্যাদি গুণের দিকে একেকজন একেকভাবে আলোকপাত করেছেন। ডিন তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে দীর্ঘ ২৭ বছরের কাজের একটি ফিরিস্তি দিয়েছেন। এত দিনে কলেজ কোন অবস্থা থেকে কোন অবস্থায় এসেছে, তিনি এর একটি নাতিদীর্ঘ বিবরণ দিলেন। সচরাচর সবাই যা বলেন, তিনি তা-ই বললেন, অর্থাৎ ২৭ বছরে কলেজের জন্য তিনি যা অর্জন করেছেন, এর কৃতিত্ব সবই সহকর্মীদের হাতে তুলে দিলেন এবং যেটুকু কাজ বাকি রয়েছে, এর দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন ও বললেন, আমি যে কাজ করতে পারিনি সেটাকে আরো অগ্রসর করে নেওয়া এখন তোমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং আমার এ অসম্পন্ন কাজ তোমরা যত সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে করবে, তোমাদের প্রতি বিদায়বেলা আমার ঋণ ততই বাড়তে থাকবে।
এ সবই গতানুগতিক চিরাচরিত কথা। আমি কোনোটিতেই নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাইনি। তবে সব শেষে তিনি যে কথাটি বললেন, তা আমার মনে বেশ দাগ কাটল। অনেকে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, 'এরপর কী? হোয়াটস নেক্সট'? অর্থাৎ অবসর জীবনে তিনি কী করবেন? অত্যন্ত স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ডিন কারি বললেন, 'কেন, যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে যাব। যে কাজ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে কাজে আবার গিয়ে যোগ দেব।' এতে কারো কাছে কিছুই পরিষ্কার হলো না। রহস্যের ধূম্রজাল বরং আরো ঘনীভূত হলো। সবাই জানেন, তিনি তাঁর জীবন শিক্ষকতা দিয়েই শুরু করেছেন। শুরুতে ফিরে যাবেন। তার মানে কি তিনি অবসর নেওয়ার পর আবার পড়াতে যাচ্ছেন? রহস্যের জট খুলল না। আমরাও কিছু বুঝতে পারলাম না। তিনি আবার বলতে লাগলেন, 'পৃথিবীতে সব কিছু তার মূলের দিকে ধাবিত হয়। মানুষও জীবনসায়াহ্নে তার মূলের দিকে ছোটে। আমি কৃষিকাজ করিনি, আমার পিতাও করেননি, পিতামহও করেননি, তাঁর পিতা কিংবা পিতামহও করেননি; কিন্তু সবার মতো আমার পূর্বপুরুষরা এ দেশে জীবন শুরু করেছেন কৃষিকাজ দিয়েই। আমি ৪০ বছর শিক্ষকতা জীবন শেষ করে সগৌরবে ফিরে যাব আমার পূর্বপুরুষদের সেই পেশা, সবার আদি পেশা কৃষিকাজে। কৃষিকাজ করে আমার জীবনের সব অপূর্ণতাকে আমি পূর্ণতা দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে চাই।' যে শিক্ষক শিক্ষকতা থেকে কৃষিতে বেশি গৌরব বোধ করেন, কৃষিতেই যিনি জীবনের পূর্ণতা খোঁজেন এমন একজন শিক্ষক, এমন একজন ডিন, এমন একজন লিডার হলেন ড. কারি। এমন পুরুষ আমার জীবনে আমি দ্বিতীয় আরেকজন দেখিনি। এখানেই আমি পেলাম কৃষির সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক। আমি আবিষ্কার করলাম মানুষের সঙ্গে মাটির সম্পর্ক। এ সম্পর্কই আসল, এটাই আদি, দীর্ঘস্থায়ী, এটাই খাঁটি। জগতের সব শিক্ষক ডিন কারির মতো হোক- এটাই আমার আজকের প্রার্থনা।

লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ; Awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.