ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসে লিমনের মায়ের মামলা শেষ

ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে গুলি করে পঙ্গু করার ঘটনায় তার মায়ের করা মামলার ব্যাপারে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে রাজাপুর থানার পুলিশ। তাতে লিমনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ থেকে র‌্যাবের ছয় সদস্যকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।


ঈদের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস গত মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি জমা দিয়ে মামলাটি শেষ করে দিল রাজাপুর থানার পুলিশ। গতকাল বুধবার বিষয়টি জানাজানি হয়।
জানতে চাইলে ঝালকাঠির পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানায় তদন্তাধীন পুরোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। লিমনের মায়ের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আমার সই নিয়েছেন। আমি পিপির (সরকারি কৌঁসুলি) মতামত নিয়ে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছি।’
চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে মামলাটি শেষ করে দেওয়ার খবর শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা হালিম সারের লগে (সঙ্গে) মঙ্গলবার রাইতেও কতা কইছি, হে আমারে কিছু কয় নাই। এর আগে হে আমারে কইছেলো, আপনারে না জানাইয়া কিছু করমু না। কিন্তু এহন হে (তদন্ত কর্মকর্তা) ঈদের বন্ধের মধ্যে গোপনে আমার সত্য মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দিয়া দিল?’
অসহায় এই মায়ের প্রশ্ন, ‘গরিব বইল্লা কি মোরা বিচার পামু না? আমার নিরীহ পোলারে র‌্যাব ধইরা গুলি কইরা পঙ্গু করল, এর বিচার নাই দেশে? উল্টা আমার পোলারে সন্ত্রাসী বানাইয়া র‌্যাবের মিছা মামলায় চার্জশিট দিল।’
নিজ বাড়ির পাশে ছেলেকে ধরে পায়ে অস্ত্র্র ঠেকিয়ে গুলি করার অভিযোগে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে গত বছরের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা করেন। মামলায় বরিশালের র‌্যাব-৮-এর তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মো. লুৎফর রহমান, করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আজিজ, নায়েক মোক্তাদির হোসেন, নায়েক প্রহ্লাল চন্দ্র ও সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাসকে আসামি করা হয়। অনেক গড়িমসির পর আদালতের নির্দেশে রাজাপুর থানা মামলাটি গ্রহণ করে। এরপর হোনোয়ারা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁর মামলাটি নিয়ে কার্যকর কোনো তদন্ত করছে না।
মামলা দায়েরের ১৩ মাস ২০ দিন (৪৭৫ দিন) পর বাদীকে না জানিয়ে মঙ্গলবার তদন্ত কর্মকর্তা রাজাপুর থানার উপপরিদর্শক আবদুল হালিম তালুকদার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
কাগজপত্রে এই মামলার ১ নম্বর সাক্ষী র‌্যাবের গুলিতে পঙ্গু হওয়া লিমন নিজে। সে প্রথম আলোকে বলে, ‘তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হালিম ১৩ মাস ধরে কী তদন্ত করেছেন আমি জানি না। কারণ, মামলার ভিকটিম এবং সাক্ষী হিসেবে তিনি আমার সঙ্গে কোনো দিন কথা বলেননি। রাজাপুর থানার পুলিশের কাছ থেকে আমি কোনো দিন ন্যায়বিচার পাব না। প্রথম থেকেই তারা মামলা নিতে অনেক টালবাহানা করেছে।’
অবশ্য তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হালিম তালুকদার দাবি করেন, তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে ও গোপনে তদন্ত করেছেন। বাদীর মনোনীত সাক্ষী ও নিরপেক্ষ সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাতে বাদীর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘লিমন যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল, তখন আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে বাদী হেনোয়ারা বেগমকে জানানো হয়েছে। হয়তো তিনি এখনো তা পাননি, তবে পেয়ে যাবেন।’
লিমনের মায়ের আইনজীবী মানিক আচার্য জানান, ঈদের পর আদালত খুললে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের গত ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বাড়ির কাছে মাঠে গরু আনতে গিয়ে র‌্যাবের গুলিতে পা হারায় লিমন (১৬)। প্রথমে গ্রামবাসী চাঁদা তুলে দরিদ্র লিমনের চিকিৎসার খরচ চালায়। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে জীবন বাঁচাতে লিমনের বাঁ পা ঊরুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন চিকিৎসকেরা। ঘটনার ১৩ দিন পর ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে লিমনের ওপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশিত হলে সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
অন্যদিকে লিমনকে গুলি করার পর ওই দিনই তার বিরুদ্ধে র‌্যাব দুটি মামলা দায়ের করে। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে। গত বছরের ২৪ এপ্রিল অস্ত্র আইনের মামলায় লিমনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। মামলাটি বর্তমানে ঝালকাঠির বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২-এ অভিযোগ গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে। আর সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে করা মামলায় গত ১ জুলাই আদালতে লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ।
এসব মামলায় লিমনকে আইনি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গত বছরের ৫ মে আসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট র‌্যাবের করা মামলায় লিমনকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন। একই সঙ্গে হাইকোর্ট সরকারকে লিমনের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। কিন্তু সরকার লিমনের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেনি। লিমনের চিকিৎসা-সহায়তায় এগিয়ে আসেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। সুস্থ হয়ে কৃত্রিম পা লাগিয়ে লিমন আবার লেখাপড়ায় ফিরেছে। তাকে প্রতি মাসে র‌্যাবের মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) মো. নূর খান বলেন, ইতিপূর্বে র‌্যাবের দায়ের করা দুটি মামলায় পুলিশ যেভাবে লিমনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে, তাতে পুলিশের কাছ থেকে লিমনের মায়ের মামলায় নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিদেন আশা করা যায় না। তিনি বলেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থায় পুলিশের পক্ষে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করা সম্ভব নয়। তাই আমরা লিমনের ঘটনার প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে আসছি।’

No comments

Powered by Blogger.