টেলিভিশনে আমরা এখন লাইভ বা সরাসরি অনুষ্ঠান দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলো করতে গেলে কত ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, তা নিয়েই এই আয়োজন -লাইভের ফাইভ

নওশীন একবার একটি অনুষ্ঠানে একজন দর্শক ফোন করেই বলে বসল, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’ আমি তো চরম বিব্রত হলাম। পরিবেশটা হালকা করতে বললাম, ‘আপনি অতিথির সঙ্গে কথা বলুন।’ তিনি অতিথি শিল্পীকে বললেন, ‘আপনি “চিরদিন তুমি যে আমার” গানটা গাইবেন। এটা নওশীনের জন্য। এরপর আরেকটা গান গাইবেন, সেটা নওশীনের শাশুড়ি, মানে আমার মায়ের জন্য ডেডিকেট করবেন।’


কী আর করা, ফোনটা কেটে দিতে হলো।
আরেক দিন চ্যানেল আইয়ের ‘রানী গানে গানে’ অনুষ্ঠানের একটি ঘটনা। এক দর্শক ফোন করে বললেন, ‘আপা, আপনার কি বিয়ে হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘শিল্পীর সঙ্গে কথা বলুন।’
তিনি সেটা যেন শুনতেই পেলেন না। আবার বললেন, ‘আপনার মনে কি খুব কষ্ট? সত্যি কি আপনার বিয়ে হয়েছে?’ সেবারও কেটে দিতে হলো ফোনের লাইন।
২.
আমার লাইভ অনুষ্ঠানের যে ঘটনাটি এখনো মনে দাগ কাটে, সেটি মা দিবসের একটি অনুষ্ঠান ছিল। শর্মিলী আহমেদ ফোন করলেন। বললেন, বুড়ো হয়ে গেলে মায়েদের কেন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে?
তার পরই ফাহমিদা নবী ফোন করে মায়ের জন্য কাঁদছিলেন।
আমি সেদিন সত্যিই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
 নওশীন: উপস্থাপক

পারভেজ চৌধুরী
আমি তখন একুশে টেলিভিশনে। ২০০৬ সাল। ঈদ উপলক্ষে নতুন কিছু করতে হবে, এমন ভাবনা থেকেই মাথায় এল সংগীতশিল্পী ও দর্শকের সরাসরি অংশগ্রহণে ভিন্নধর্মী কোনো অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যায় কি না। এ ভাবনা থেকেই শুরু হলো ফোনোলাইভ স্টুডিও কনসার্ট। শুরুটা করেছিলাম আমিই। তবে শুরুতে ঝক্কিও কম ছিল না। এ ধরনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে কারও কোনো ধারণা ছিল না। সে সময় গানের অনুষ্ঠান করতে হলে শিল্পীরা আগেভাগে গান রেকর্ড করতেন কিংবা টিভি স্টুডিওতে গান করতেন। কিন্তু সরাসরি গানের অনুষ্ঠান, যেখানে দর্শক ফোনে সরাসরি কথা বলবেন শিল্পীর সঙ্গে—এই পুরো ব্যাপারটি প্রথম দিকে ঠিকভাবে শিল্পীরাও বুঝতে পারছিলেন না। ফলে সংশয় ছিল শিল্পী-কলাকুশলী সবার মধ্যেই। রাজি হচ্ছিলেন না কেউই।
এ সময় দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পা মজুমদারকে পরিকল্পনাটির কথা বললাম। সানন্দে রাজি হলেন তাঁরা। তোড়জোড় শুরু হলো। উত্তেজনার শেষ নেই! এর মাঝে কারা যেন বাপ্পাকে ফোন করে বলল, অনুষ্ঠানটি হবে না। অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগে রাতে বাপ্পা মজুমদার আমাকে ফোন করে বললেন, ‘ফোনোলাইভ নাকি হচ্ছে না!’ আকাশ থেকে পড়লাম। জানালাম, ‘ফোনোলাইভ হবে।’ যেহেতু লাইভ অনুষ্ঠান, সুতরাং সবাইকে ঠিক সময়ে স্টুডিতে থাকতে হবে। টিভি স্ক্রিনে বারবার প্রোমোতে অনুষ্ঠানের সময়সূচি জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভোর থেকে আমাদের উত্তেজনা তুঙ্গে পৌঁছাল। এবার সব ঠিকঠাকমতো হলেই হয়। লাইভ অনুষ্ঠান করার সময় পাহাড়ি রাস্তার মতো শুধু পা ফেলার জায়গাটুকু দেখা যায়, বাকিটা থাকে অজানা। সঞ্জীবদা উড়নচণ্ডী মানুষ। তাই অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে তাঁর বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে দিলাম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। এ ঘটনায় খুব মন খারাপ করেছিলেন সঞ্জীবদা। ফোনোলাইভ শুরু হলো সকাল সাড়ে ১০টায়। যথাসময়ে যন্ত্রীরা এলেন। এলেন বাপ্পা ও সঞ্জীবদা। এসেই অভিমানী কণ্ঠে সঞ্জীবদা বললেন, ‘আপনারা কি আমাকে এতই দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে করেন? আমার ওপর আস্থা রাখতে পারলেন না, রাত থেকেই আমার বাসায় গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন!’ সঞ্জীব চৌধুরী তাঁর প্রতি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করার কারণে অভিমান করেছিলেন। তবে সেই মান ভাঙতেও দেরি হয়নি। ধীরে ধীরে প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফোনোলাইভ। সব চ্যানেলেই ্এখন নিয়মিতভাবে প্রচারিত হয় এই অনুষ্ঠান। আমাদের দেশের ফোনোলাইভ এরপর ভারতেও শুরু হয়েছে এই ধারা। ফোনোলাইভ অনুষ্ঠানকে ঘিরে শিল্পী, যন্ত্রী ও দর্শকের মধ্যেও এসেছে নতুন এক উন্মাদনা। বিষয়টি ভাবতে ভালোই লাগে। এবার নতুন কিছু করতে হবে, অন্য রকম...
 পারভেজ চৌধুরী: অনুষ্ঠান প্রধান, দেশ টিভি।

আলফ্রেড খোকন
সরাসরি সম্প্রচারিত কোনো অনুষ্ঠানে আগেভাগেই অতিথিদের স্টুডিওতে আসার নিয়ম। অনুষ্ঠানের আগে অতিথিকে মেকআপ নিতে হয়, ক্লিপ (মাইক্রোফোন) পরাতে হয়, যে কারণে বেশ খানিকটা সময় লাগে। তাই অনুষ্ঠান শুরুর কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে আমন্ত্রিত অতিথিরা স্টুডিওতে পৌঁছে যান। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছিল একবার। আমি এনটিভিতে তখন নিয়মিতভাবে ‘ব্র্যান্ড ফোরাম’ নামে একটি লাইভ অনুষ্ঠান করতাম। রাত সাড়ে ১০টায় প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকতেন করপোরেট সেক্টরের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা। এক দিনের ঘটনা, ওই দিন অনুষ্ঠানের অতিথি চারজন। এর মধ্যে একজন ছিলেন একটি ফোন কোম্পানির উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তা।
সব আয়োজন শেষ। ওই নারী কর্মকর্তা ছাড়া অন্য অতিথিদের সবাই এসে গেছেন। তখন পিএসের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছিল। অফিসে বসে পিএস বলছিলেন, ‘ম্যাডাম আপনাদের অনুষ্ঠানের জন্য বেরিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।’
সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু এই ‘কিছুক্ষণ’ আর শেষ হচ্ছে না। ওই দিকে টেনশন বাড়ছে আমাদের। এ সময় ভাবলাম, ওই কর্মকর্তা যদি অনুষ্ঠান শুরুর মুহূর্তেও না এসে পৌঁছান, তাহলে ক্যামেরার সামনে থেকে কৌশলে তাঁর চেয়ারটি সরিয়ে নেব। এটিও অনেক ঝামেলার ব্যাপার। অনুষ্ঠানের যখন মাত্র এক মিনিট বাকি, তখন পিএস জানালেন, ‘ম্যাডাম আপনাদের লিফটে।’ তবে সেই লিফটও আর ওপরে উঠছে না! আমাদের স্টুডিও অষ্টম তলায় হওয়ায় লিফটেই তাঁকে আসতে হবে। অনুষ্ঠানের যখন আর ১০ সেকেন্ড মাত্র বাকি, তখন এসে পৌঁছালেন তিনি। শাড়ির সঙ্গে কোনো রকমে ক্লিপ গুঁজে দিয়ে মেকআপ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে স্টুডিওতে পাঠানো হলো তাঁকে। অনুষ্ঠান শুরু হলো। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম সবাই।
 আলফ্রেড খোকন: নির্বাহী প্রযোজক, এনটিভি।

আলমগীর হোসেন
২০১০ সালে দেশ টিভির ঈদের কলের গানে এসেছিলেন জেমস। অনুষ্ঠান শুরু হবে রাত পৌনে ১২টায়। দলবলসহ জেমস ভাই এলেন আটটার দিকে। তাঁকে বললাম, ‘রাতে কী খাবেন?’ ‘আমরা তো সব মিলিয়ে আটজন আছি, রাতে বার্গার খাব, বার্গার নিয়ে আসো’—জেমস ভাইয়ের উত্তর।
শিল্পীর কথামতো বেইলি রোডের হেলভেশিয়া থেকে বার্গার নিয়ে এলাম আমরা। যথাসময়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। প্রথম গানেই আসর মাত করেছেন জেমস। অনুষ্ঠান চলছে, সবকিছু ঠিকঠাক। ১৫ মিনিট পর ছোট্ট একটি বিরতিতে গেলাম। এ সময় জেমস ভাই আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার ভাতের খিদে পেয়েছে রে, মাংস দিয়ে ভাত খাব...।’ তাঁর এই কথা শুনে আমার চক্ষু তো চড়কগাছ! তখন রাত ১২টা পেরিয়ে গেছে। ঈদের সময় ঢাকা শহর প্রায় খালি। হোটেলও বন্ধ। এ মুহূর্তে ভাত পাব কোথায়? কথাটি তাঁকে বলতেই বললেন, ‘ওসব জানি না, যেখান থেকে পারিস, ভাত নিয়ে আয়। দরকার হলে কারও বাসা থেকে নিয়ে আয়।’ ভাতের সন্ধানে গাড়ি ছুটল ঢাকার রাস্তায়। কিন্তু হোটেল খোলা নেই। অগত্যা আমার বন্ধুবান্ধবকে ফোন করলাম, যদি তাদের বাসায় ভাত রান্না করা যায় এই আশায়। কিন্তু কেউই তখন ঢাকায় নেই। একবার ভাবলাম, ভাবি, মানে জেমস ভাইয়ের স্ত্রীকে বলি, ‘১০-১২ জনের জন্য ভাত রান্না করেন।’ পরমুহূর্তেই পরিচিত এক হোটেলের কথা মনে হলো। সেই মধ্যরাতে অনেক বলেকয়ে তাদের দিয়ে ভাত-মাংস রান্না করানো হলো।
অবশেষে ভাত এল। জেমস ভাই তৃপ্তিসহকারে ভাত-মাংস খেলেন। ফোনোলাইভের পর খাওয়াদাওয়া শেষে ঘটনাটি জেমস ভাইকে বলতেই হেসে উঠলেন তিনি। পরে অবশ্য ঘটনাটি মনে করে আমি নিজেও হেসেছি।
 আলমগীর হোসেন: নির্বাহী প্রযোজক, দেশটিভি।

সায়েম
বাংলাভিশনের এক লাইভে যে অতিথির আসার কথা ছিল, তিনি আসবেন না। তো প্রযোজক বললেন, ‘আপনার পুরো শোটা চালিয়ে নিতে হবে।’
শুরু করলাম। সে সময় আমি সবে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখা শুরু করেছি।
এক দর্শক ফোন করলেন, ‘আপনি এই রকম ছাগলের মতো দাড়ি রেখেছেন কেন?’
আমি আর কী বলি! যথারীতি অপ্রস্তুত! তবু সুন্দর করে হেসে বললাম, ‘এটা আমার সৌন্দর্যের অংশ। ভোটাভুটি করে দেখেছি, বেশির ভাগ মানুষ এই দাড়ি রাখার পক্ষে রায় দিয়েছেন।’
তারপর ফোন আসা শুরু করল। কেউ বলল, ‘ভাইয়া, আপনি দাড়ি রাখবেন। এই স্টাইলে আপনাকে ভালো লাগে।’
কেউ বলল, ‘আপনাকে এভাবেই বেশি মানায়।’
পুরো শো এমন দাঁড়িয়ে গেল যে, মনে হতে লাগল, এটা একটা দাড়ি শো!
২.
জেগে আছো কি অনুষ্ঠানের ১৫০তম পর্ব। তিনটি বাচ্চাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হবে। শুরুতে পরিকল্পনা ছিল, বাচ্চারা কেক কাটবে। তারপর তাদের আমরা চকলেট দেব।
বাচ্চারা কেক কাটল। তাদের চকলেট দেওয়ার সময় চকলেট আর খুঁজে পাই না। নওশীন আমার দিকে ইশারা করছে। আমি নওশীনের দিকে। আসলে আমাদের কাছে চকলেট ছিল না। পেছন থেকে প্রোডাকশনের একজন এসে চকলেট দিয়ে গেল। তখন লাইভ হচ্ছে। হঠাৎ ম্যাজিশিয়ানের মতো সুর করে বললাম, ট্যা...ট্যা...ট্যা ! এই দেখো জাদু! তোমাদের জন্য চকলেট এসে গেছে। এভাবে ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম। দর্শক নিশ্চয়ই ভেবেছিল, এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা।
 সায়েম: উপস্থাপক
ঈদ আনন্দ প্রকাশে সহযোগিতা করেছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ, শফিক আল মামুন, সুজাত হোসেন, মারুফ ইসলাম ও সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.