চাঁদরাতের অপেক্ষা by আহমেদ মুনির

‘ঈদের চাঁদ দেখা গেলে বাবার সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরা রিয়াজুদ্দিন বাজারে যেতাম কেনাকাটার জন্য। চাঁদরাতেই শুরু হতো আমাদের কেনাকাটা। একটা উৎসব উৎসব ভাব থাকত। পাড়া-মহল্লার পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হতো। কেনাকাটার ফাঁকে চলত গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া। প্রায় মাঝরাত পার করে হইহুল্লোড় করতে করতে বাড়ি ফিরতাম।’


নগরের আগ্রাবাদের হাজীপাড়ার পুরোনো বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. সিরাজুল ইসলাম চাঁদরাতের কেনাকাটার সুখকর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কথাগুলো বললেন। তাঁর বাবা হাজি ওসমান গণি ছিলেন শহরের নামকরা সওদাগর। চাঁদরাতে কেনাকাটা তাঁদের পরিবারের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ছিল। ভাইবোনদের মধ্যে এখনো কেউ কেউ তেমন ঐতিহ্য ধরে রাখলেও ব্যস্ততার কারণে তিনি আগের মতো আর চাঁদরাতের জন্য অপেক্ষা করেন না। তবে টুকটাক কেনাকাটার জন্য একবার অবশ্যই বের হন। উদ্দেশ্য উৎসবের আমেজটাকে উপভোগ করা।
চট্টগ্রামের পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা ঈদের কেনাকাটার জন্য চাঁদরাতের অপেক্ষায় থাকতেন। এখনো কেউ কেউ এই অভ্যাস ধরে রেখেছেন। সারা রমজান মাসে যত কেনাকাটাই করুন না কেন, চাঁদরাতে একবার মার্কেটে যাওয়া চাই।
ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ছে নগরের বিপণিকেন্দ্রগুলোতে। চট্টগ্রামের বাইরের বাসিন্দাদের অনেকেই কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির পথ ধরেছেন। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী, বিপণিকেন্দ্রের বিক্রয়কর্মী ও নিম্নআয়ের লোকজনের মধ্যে অনেকেরই এখনো কেনাকাটা শেষ হয়নি। এঁদের একটা অংশ অপেক্ষা করবেন চাঁদরাতের জন্য।
রিয়াজুদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী প্রগতি ক্লথ স্টোরের স্বত্বাধিকারী নুরুল আমিন জানান, নগরের আন্দরকিল্লা, এনায়েতবাজার, লালখানবাজার, ফিরিঙ্গিবাজার, চন্দনপুরা, বাকলিয়া ও আলকরণ এলাকার মানুষজন চাঁদরাতে উৎসবের মেজাজে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। এসব ক্রেতার কথা মাথায় রেখে ফজরের আজান পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন তাঁরা। তিনি আরও বলেন, ‘মার্কেটের অনেক বিক্রয়কর্মী চাঁদরাতে বেতন-বোনাস পান। এঁরাও তখন বাড়ির আত্মীয়স্বজনের জন্য কেনাকাটা করেন। তবে বছর দশেক আগেও স্থানীয় লোকজনের সিংহভাগই চাঁদরাতের জন্য অপেক্ষা করতেন। এখন রোজার সারা মাসেই সবাই টুকটাক কেনাকাটা করে রাখেন। তাই ভিড় আগের মতো হয় না।’
নগরের আমতল এলাকায় আতর-টুপি ফেরি করে বেড়ান মো. সোলায়মান। চাঁদরাতের জন্য অপেক্ষা তাঁরও। তিনি বলেন, ‘জামা, জুতা কেনা শেষ হইলে সবাই আতর, টুপি কেনে। আর চাঁদ রাইতেই বিক্রি হয় বেশি। সারা রোজায় যা বিক্রি হয়, এই এক রাইতেই তার চাইতে বেশি বিক্রি হয়।’
ইতিহাসবিষয়ক গবেষক শামসুল হোসাইনের কাছে চাঁদরাতে কেনাকাটার অতীত ঐতিহ্য নিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘৫০-৬০ বছর আগে এত মার্কেট ছিল না। তখন মার্কেট বলতে ছিল আন্দরকিল্লা, টেরিবাজার এসব। আগেকার দিনে চট্টগ্রামের সওদাগর পরিবারে রেওয়াজ ছিল চাঁদরাতে কেনাকাটা করা। সারা রমজান মাসে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ততা ছিল যাঁদের, তাঁরা বাধ্য হয়েই চাঁদরাতে ঈদের বাজার করতেন।’
আগ্রাবাদ শেখ মুজিব সড়কের পুরোনো একটি মহল্লা মির বাড়ি। এখানকার বাসিন্দা রাজনৈতিক-কর্মী হাসান মারুফ জানান, মহল্লার পরিবারগুলো এখনো চাঁদরাতে কেনাকাটার রেওয়াজ ধরে রেখেছে। উঠতি বয়সের তরুণদের একটা অংশও চাঁদরাতে কেনাকাটার জন্য বের হয়। কাপড়, গেঞ্জি, লুঙ্গি, আতর, সাবান, জায়নামাজ, সেমাইসহ নানা জিনিস কেনার জন্য এই রাতে মহল্লাবাসী মার্কেটে যান। কেনাকাটার পাশাপাশি চলে উৎসব উদ্যাপন। নগরের আগ্রাবাদ এলাকার আখতারুজ্জামান সেন্টারের সক শপের স্বত্বাধিকারী মো. মনসুর জানান, শহরের বইরে গ্রামের বাড়িতে যাঁরা ঈদ করবেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কেনাকাটা শেষ। অফিসপাড়ার লোকজনেরও কেনাকাটা শেষ পর্যায়ে। তবে ব্যস্ততার কারণে যাঁরা এত দিন কেনাকাটা করতে পারেননি, তাঁরা এখন মার্কেটে আসছেন। চাঁদরাতেও স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকে আসবেন কেনাকাটা করতে।
চাঁদরাতে দোকান কয়টা পর্যন্ত খোলা রাখবেন এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ ক্রেতারা থাকবেন, ততক্ষণ দোকান খোলা থাকবে।’
নগরের একটি হোটেলে কাজ করেন মো. হোসেন। এখনো বেতন পাননি তিনি। মালিক অবশ্য বলেছেন ঈদের দু-এক দিন আগে মিলবে মজুরি। মো. হোসেন বলেন, ‘বেতন পাইলে প্রথমে মেয়ের জন্য জামা কিনব। টাকায় কুলালে পরিবারের সবার জন্য টুকটাক কেনাকাটা করব। তয় জানি না, আল্লায় কপালে কী রাখছে।’

No comments

Powered by Blogger.