শরীফ এনামুল ফের জাবি উপাচার্য by অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য ও ইমন রহমান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে তিনজন নির্বাচিত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সিনেট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত তিনজন হলেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির, বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক ড. নুরুল আলম।


তাঁদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন শরীফ এনামুল কবির। নির্বাচিত তিন সদস্যের নাম আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) কাছে পাঠানো হবে। তিনি এ তালিকা থেকে যেকোনো একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
বর্তমান সরকারের আমলে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই প্রথম উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন।
গত ১ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর ১৯ দিন পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচন উপলক্ষে সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাসে ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন ছিল। অসন্তুষ্ট হলেও আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, পুরো বিষয়টি তাঁরা পর্যবেক্ষণ করছেন। আজ শনিবার থেকে তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাবেন। তাঁরা নির্বাচনের এ দিনটিকে (২০ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কালো দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
২০০৪ সালে সর্বশেষ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়েছিল। সিনেটের ৮৭ সদস্যের মধ্যে ২৪ জন নির্বাচনে অংশ নেননি। এ ছাড়া নির্বাচনের বিরোধিতা করে উপাচার্য প্যানেলের এক প্রার্থীসহ পাঁচ সদস্য নির্বাচন বয়কট করেন। বয়কট করা প্রার্থী শামসুল কবির খান তিন ভোট পেয়েছেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তিনি তা বয়কট করেন।
নির্বাচনে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির সর্বোচ্চ ৫০ ভোট পেয়েছেন। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ৩৮ ও পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নুরুল আলম ৩৭ ভোট পেয়ে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন।
অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে গত ১৭ মে উপাচার্যের পদ ছেড়েছিলেন। পদত্যাগের দুই মাস পর উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি সর্বোচ্চ ভোট পান।
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ড. শরীফ এনামুল কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি আনন্দিত। আবারও উপাচার্য হওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।'
নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ায় স্বাগত জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা চাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় বিধি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে চলুক। নির্বাচনের ফল অনুযায়ী প্যানেলের তালিকা আমাদের কাছে আসবে। ওই তালিকা থেকে বিধি অনুযায়ী একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হবে এবং খুব দ্রুত এ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে।'
বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, '১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয়েছে। এর ফলে অন্ধকার কেটে গেছে, আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নির্বাচন নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ বিরোধিতা করেছেন; কিন্তু কোর্টের নির্দেশনার কারণে বিরোধিতাকারীদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করায় তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।'
ড. শরীফ এনামুল কবির বেশি ভোট পাওয়ার বিষয়ে বর্তমান উপাচার্য বলেন, 'আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। উপাচার্য নিয়োগের জন্য নির্বাচিত প্যানেল তৈরির কথা ছিল, উৎসবমুখর পরিবেশে সব বিধিবিধান মেনে এটি করা হয়েছে।'
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, 'নির্বাচিত প্যানেলের মধ্য থেকে আচার্য একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন। যিনি উপাচার্য হিসেবে মনোনীত হয়ে আসবেন, আশা করি তিনি সবাইকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন। আর সেই ভবিষ্যৎ-উপাচার্যের জন্য রইল আগাম শুভেচ্ছা।'
আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, এ নির্বাচন অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপাচার্য বলেন, 'নির্বাচন যদি আপনারা না মানেন তাহলে আমি পুনরায় বলব, আপনারা বিচারের দারস্থ হন।'
গতকাল সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে বিশেষ সিনেট অধিবেশন শুরু হয়। ১১টায় শুরু হয় ভোটগ্রহণ। দুপুর সাড়ে ১২টায় ফল জানানো হয়। অধিবেশনে ৬৮ জন সিনেটর উপস্থিত থাকলেও ভোট দেন ৬৩ জন। উপাচার্যের প্যানেল নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক। সিনেটরদের মধ্য থেকে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য প্রথমে ছয়জনের নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করা হয়। তাঁরা হলেন অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির, অধ্যাপক ড. নুরুল আলম, অধ্যাপক ড. আফসার আহমেদ, অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন ও শামছুল কবির খান। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন অধ্যাপক ইসমাইল হোসাইন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে নির্বাচন হয়। নির্বাচন প্যানেল করে হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।
রিটার্নিং অফিসার জানান, নির্বাচনে অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন পেয়েছেন ৩৫ ভোট, অধ্যাপক ড. আফসার আহমেদ পেয়েছেন ১৮ ভোট, অধ্যাপক ড. নুরুল আলম পেয়েছেন ৩৫ ভোট, শামছুল কবির খান পেয়েছেন তিন ভোট এবং অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির পেয়েছেন ৫০ ভোট। ড. আনোয়ার হোসেন ও ড. নুরুল আলমের ভোট সমান হওয়ায় এ দুজনের মধ্যে পাঁচবার টস হয়। প্রতি টসকে একটি ভোট হিসেবে গণনা করা হয়। এতে ড. আনোয়ার তিন ভোট পান ও ড. নুরুল আলম পান দুই ভোট। এর ফলে অধ্যাপক ড. আনোয়ারের মোট ভোট ৩৮ ও অধ্যাপক ড. নুরুল আলমের ভোট ৩৭-এ দাঁড়ায়। ভোটগ্রহণ চলাকালে ক্যাম্পাসে ব্যাপকসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও নাসিম আকতার হোসাইন বর্তমান উপাচার্যকে 'টিক্কা খানের সঙ্গে তুলনা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন উপাচার্য। তিনি বলেন, 'আমি টিক্কা খান নই, মুক্তিযোদ্ধা।'
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নির্বাচন বয়কট করে সিনেট অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসেন এক প্রার্থীসহ পাঁচজন। তাঁরা হলেন রাশেদুল ইসলাম মাসুম, আশরাফ উদ্দিন, শামছুল কবির খান, রায়হান শরীফ বাদল ও এনামুল্লাহ পারভেজ। পরে দুপুর ২টায় নির্বাচন বয়কটকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সংবাদ সম্মেলনে শামছুল কবির খান বলেন, 'নির্বাচনে সবাই অংশ নেননি। প্রশাসন সবাইকে অংশগ্রহণ করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর সব দায় উপাচার্যের ওপর বর্তায়। সবাই অংশ নেননি বলে আমরা নির্বাচন বয়কট করে চলে এসেছি।' রায়হান শরীফ বাদল বলেন, 'ক্যান্টনমেন্টর মতো পরিস্থিতি তৈরি করে যে নির্বাচন হয়, তাতে আমরা অংশগ্রহণ করতে পারি না। আমরা উপাচার্যকে বলেছিলাম, আমাদের সবাইকে নিয়ে নির্বাচন দিন, আমরা আপনার নিরাপত্তা দেব।'
সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের মৌন মিছিল : এর আগে সকাল ১০টার দিকে প্রশাসিনক ভবনের সামনে আন্দোলনকারী চার শিক্ষকের অনশন ভাঙান সিনেট সদস্য আশরাফ উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন, মির্জা আলাউদ্দিন ও রায়হান শরীফ বাদল। অনশন ভাঙার পর সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের সদস্যরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে একটি মৌন মিছিল করেন। পাশাপাশি রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে শিক্ষকরা কালো কাপড়ে লেখা বিভিন্ন ব্যানার টাঙিয়ে রাখেন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধিতা করে আসছে শিক্ষকদের একটি অংশ। এ অংশটি 'সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ' নাম দিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে নানা কর্মসূচি দিয়ে আসছে। তাঁদের ডাকে সর্বাত্মক ধর্মঘটে ১৫ জুলাই থেকে অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। ওই সময় প্রশাসনিক ভবনের তালাও খুলতে দেননি আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করার জন্য নির্দেশ দেন। এ নির্দেশের পর গতকাল সকালে তাঁরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।
দুপুর আড়াইটায় নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম এ মতিন বলেন, 'আমরা কখনো বলিনি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন চাই না। আমরা শুধু বলেছি, যেভাবে নির্বাচনটি চেয়েছিলাম সেভাবে হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম অন্যান্য নির্বাচন আগে হবে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন পরে দেওয়া হোক।' তিনি বলেন, 'হাইকোর্টের নির্দেশে আমরা আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে এসেছি।'
আবারও আন্দোলনের আভাস : ড. শরীফ সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক ও সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের নেতা অধ্যাপক ড. নাসিম আকতার হোসাইন বলেন, 'ড. শরীফ এনামুল কবির ফের উপাচার্য হলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের জন্য এটি হবে দুঃখজনক।' তিনি বলেন, 'সিনেট হচ্ছে ড. শরীফের সাজানো প্রতিনিধি পরিষদ এবং ওই সাজানো পরিষদের প্রতিনিধিরাই ড. শরীফকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন।' তিনি বলেন, 'সাবেক উপাচার্যের কাঠামো বহাল তবিয়েতে আছে এবং সেটি যে কত শক্তিশালী ও অনুগত- এটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্যই নির্বাচনের এ দিনটিকে আমরা কালো দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে উপাচার্য চান। বাইরের কাউকে উপাচার্য হিসেবে মানবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, তিনজনের প্যানেল থেকে ড. আনোয়ার হোসেনকেই পরবর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। তাদের মতে, আনোয়ার হোসেনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিলে বিভিন্ন অজুহাতে আবার উত্তপ্ত হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিষয়ে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক এম এ মতিন বলেন, 'আমরা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'

No comments

Powered by Blogger.