বাকরুদ্ধ মা, শয্যাশায়ী by আজিজুল পারভেজ

ছেলে হারানো শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ। শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন ৮০ বছর পেরোনো এই শহীদজায়া। স্যালাইন ছাড়া আর কোনো খাবারই গ্রহণ করছেন না।


বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে তাঁর এ অবস্থা। তিনি অবস্থান করছেন কনিষ্ঠপুত্র কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের রাজধানীর পল্লবীর ২৪/৪ নম্বর বাড়িতে। তাঁকে কেন্দ্র করে পরিবারের আত্মীয়স্বজনও অবস্থান করছেন এ বাড়িতে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে আহসান হাবীবের পল্লবীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শোকে স্তব্ধ পুরো বাড়ি। হুমায়ূন আহমেদের অনুজ আহসান হাবীব জানান, 'আম্মা কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। কোনো খাবারও নিচ্ছেন না। তাঁকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।' আয়েশা ফয়েজকে ঘিরে রয়েছেন তিন কন্যা সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ ও রোকসানা আহমেদ এবং নিকটাত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীরা।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন আয়েশা ফয়েজ। ঘুমানোরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুই চোখের পাতা এক হলে মুহূর্তেই কেঁপে ওঠেন, চোখ খুলে কিছু একটা খুঁজতে থাকেন।
আহসান হাবীব বললেন, 'বৃহস্পতিবার রাত তখন ১১টা হবে। মেজো ভাবি (মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপিকা ইয়াসমিন হক) নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন দিলেন। বললেন, তোমার বড় ভাইকে তো আর ধরে রাখতে পারছি না। ক্রমাগত ওর রক্তচাপ নিচের দিকে নামছে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আমাদের আত্মীয়স্বজন বড় ভাইকে ঘিরে রেখেছিল। একসময়, মেজো ভাবি বলে উঠলেন, তোমার বড় ভাই আর নেই। খবরটি শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।' দুঃসংবাদটি গোপন না রেখে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেন মা আয়েশা ফয়েজকে। তিনি বলেন, 'একাত্তরে স্বামী ও ভাইকে হারানোর পর আজ সবচেয়ে কষ্টের মুখোমুখি আমার মা। অনেক সহ্যক্ষমতার অধিকারী মা আজ এত বড় শোক যেন ধারণ করতে পারছেন না। বুকের ভেতরে কষ্ট চাপা দিয়ে অনেকটা অর্ধচেতন হয়ে আছেন। কিছুই মুখে দিচ্ছেন না। শুধু স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।'
আহসান হাবীব জানান, ভাইকে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ছিল মায়ের। আরো আগে যেতে পারতেন। কিন্তু তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় দেরি হয়েছে। ভিসার প্রক্রিয়া চলছিল। কথা ছিল সুস্থ অবস্থায় বড় ভাইকে নিয়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু মায়ের আর যাওয়া হলো না। ভাই আসছেন বটে, তবে লাশ হয়ে। আর কখনো মাকে জড়িয়ে ধরবেন না তিনি, পা ছুঁয়ে সালাম করবেন না।
আহসান হাবীব বলেন, 'হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই মাকে ফোন করতেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলতেন। স্মৃতিচারণাও করতেন। আর বলতেন, আমি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরব, তুমি চিন্তা করো না। আমার জন্য দোয়া করো।'
আহসান হাবীব আরো জানান, একসময় ব্যাপক ধূমপান করতেন হুমায়ূন আহমেদ। এ কারণে তাঁর ফুসফুস অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। বারবার পানি জমে যাচ্ছিল। তাই পরপর দুটি অপারেশনের ধকল সামলাতে পারেননি। নইলে হয়তো এ যাত্রায় তিনি ফিরে আসতেন সবার মাঝে।
আহসান হাবীব বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, 'এটা আমাদের পরিবারের জন্য অনেক বড় শোকের ঘটনা। পারিবারিকভাবে তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। অনেক বড় একটা শূন্যতা রেখে গেলেন তিনি।'
হুমায়ূন আহমেদের মা ও ভাইকে সমবেদনা জানাতে শুক্রবার পল্লবীর বাসায় যান জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, প্রকাশক আলমগীর হোসেন, শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীরা পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানাতে গিয়েছিলেন পল্লবীর বাসায়।
গুলতেকিন বিদেশে, সন্তানরা খোঁজ নিচ্ছেন
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন কি না তা জানা যায়নি। তবে হুমায়ূন-গুলতেকিন দম্পতির সন্তানরা বাবার মৃত্যুতে বেদনাহত। মেয়ে নোভা ও শীলা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ আহমেদ বৃহস্পতিবার রাতে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরপরই স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আহসান হাবীবের পল্লবীর বাসায় ছুটে যান।

No comments

Powered by Blogger.