ভিন্নমত-বাংলাদেশ অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে যে কারণে by আবু আহমেদ

আমাদের অর্থনীতিটা উঠতে গিয়েও উঠতে পারছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতি পেছনে চলে যাচ্ছে। গত তিন বছর অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। মানুষের প্রকৃত আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তিন বছরে যদি মোট ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাহলে এটা বলা যায় একজন স্থির আয়ের মানুষ আগের তুলনায় ৩৬ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে।


এ অবস্থায় সমূহবিপদে পড়েছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষগুলো। আজকে সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ওই গতি হ্রাস কি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে ঘটছে, না সরকারের মূল্যস্ফীতিবিরোধী নীতিমালার জন্য ঘটছে- সেটা ভেবে দেখা দরকার। সরকার এমন কোনো বড় নীতি গ্রহণ করেনি, যার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তারা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে; বরং সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয়কে কেড়ে নিচ্ছে এবং অর্থনীতিতে একটা মন্দাবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেটা কিভাবে এরই একটু বিশ্লেষণ দিচ্ছি।
এক. অর্থনীতি যদি ভালো থাকত তাহলে তো অর্থমন্ত্রীর গত বাজেট বক্তৃতায় যে বলেছিলেন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি বাড়বে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ করে। সেই অর্জন কি বছর শেষে অর্জিত হচ্ছে? বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি বড় জোর ৬ শতাংশ হতে পারে, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে ৭ এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে পার্থক্য কত, কত হাজার কোটি টাকার সেবা ও পণ্য এই অর্থনীতিতে কম উৎপাদিত হয়েছে? অন্য প্রশ্নটি হলো, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ একযুগের মধ্যে এই অর্থনীতিতে সর্বনিম্ন অর্জন। আর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করার জন্য সরকারের কোনো পলিসি সাপোর্ট দরকার আছে বলে কোনো অর্থনীতিবিদই মনে করেন না।
দুই. আমাদের অর্থনীতি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না কেন? মোটা দাগে উত্তর হলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ হলে অর্থনীতি ৭ শতাংশ হিসাবে বাড়তে পারত, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ অর্থনীতি পাইনি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে কি সেই পরিমাণ বিনিয়োগ বেড়েছে? বাস্তবতা হলো এই অর্থনীতি ২০-২২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ পাইনি; বরং আরো কম পেয়েছে।
তিন. কেন অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পেল না- সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আগ থেকেই ছিল, তবে সেসব সমস্যার সমাধান করার জন্যই তো জনগণ এই সরকারকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু মুখ্য কারণ হলো, আমার মতে সরকারের কিছু ভুল পলিসি। ভুল পলিসির মধ্যে অন্যতম হলো বিনিয়োগবিরোধী বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি। লক্ষ করবেন, জুন ২০১০ পর্যন্ত এই অর্থনীতি মোটামুটি সঠিক পথেই এগোচ্ছিল। মূল্যস্ফীতি সহনীয় ছিল। আমাদের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে ভালো মান বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছিল। অর্থনীতিতে সুদের হার কম ছিল। চারদিকে বিনিয়োগ তহবিলের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু ২০১০ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শিখিয়ে দেওয়া ছকে যখন নতুন মুদ্রানীতি গ্রহণ করল, তখন থেকেই অর্থনীতিতে তারল্য সংকট দেখা দিল। সুদের হার দ্বিগুণ হলো। বিনিয়োগের জন্য তহবিলের টানাটানি শুরু হলো। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক কাজ-কারবারকে বৃদ্ধি করার জন্য নতুন করে তহবিল পেল না। তাদের ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে গেল। বিনিয়োগে ধস নামল। যার ফল হলো আজকের দিনে মন্দা এবং কম প্রবৃদ্ধির বৃত্তে অর্থনীতিকে বেঁধে ফেলা। আজও সেই একই মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসরণ করে চলেছে। ফল হচ্ছে সেই একই- কম বিনিয়োগ, কম উৎপাদন এবং কম প্রবৃদ্ধি অর্জন। একটা চলমান অর্থনীতিকে একটা ভুল মুদ্রানীতি যে কিভাবে পেছনে ঠেলে দিতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু দুঃখ হলো, সরকার এই ভুল পলিসি থেকে উঠে আসার কোনো চেষ্টাই করেনি; বরং একনিষ্ঠভাবে আইএমএফ যে শর্ত দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোই পরম উপজীব্য ভেবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কারণ কী? কারণ কিছুটা অজ্ঞতা, কিছুটা আইএমএফের সেই এক বিলিয়ন ডলারের ইসিএফ (ECF) ঋণ। ঋণ বেচতে চাইলে আইএমএফ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক শর্তই দেবে। কিন্তু বিনিয়োগবিরোধী ওই সব শর্ত মেনে কোনো বোদ্ধা সরকার কি ঋণ নিতে পারে? সত্য হলো, আমাদের সরকার সেই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণটা পাওয়ার জন্য বড়ই পেরেশান। এরই ফল হলো আজকের অর্থনীতিতে বন্ধ্যত্ব।
চার. কেউ কি কোনো দিন শুনছে, প্রবৃদ্ধি কমে গেলে সেই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমে? কিন্তু সরকার তো তা-ই বলছে! সত্য হলো, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমার কারণে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেছে। যে অর্থনীতি কম ব্যয়ে প্রবেশ করে, সেই অর্থনীতি শুধু পেছনেই যেতে থাকে। অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে যে মূল্যস্ফীতি কমার কথা বলা হচ্ছে, তা অর্থনীতির জন্য কি ভালো? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির সোনালি দিনগুলোকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি।
পাঁচ. অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ময়দানে। ভীতিকর একটা অবস্থার মধ্যে বিনিয়োগ তো হবেই না বরং অর্থনীতি থেকে আয় বিদেশে উড়াল দেবে। কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন পথে বাইরে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনীরা নিজ দেশকে আয় ধারণের জন্য নিরাপদ মনে করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হলো কেন? এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বরং চোখের সামনে যেটা দেখছি, সেটা হলো আমাদের এই প্রিয় দেশ একটা ভীতিকর অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এটাই আজকে বোদ্ধা সমাজকে বারবার ভাবিয়ে তুলছে। রাজনীতি যদি অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়, সেই অর্থনীতিতে আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তখন যেটা বেচে থাকে, সেটা হলো চাঁদাবাজি, চোরাকারবারী এবং রেন্ট সিকিং (Rent Seeking)। এ ধরনের অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না। সাধারণ জনগণ দুষ্টপথে উপার্জিত অর্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। অনেকের অবস্থা অনেকটা তা-ই। সেই অবস্থা ভাঙার জন্য অথবা আমাদের ভুলনীতির সৃষ্ট কম আয়ের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ছয়. সরকারি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই অর্থনীতি একটি বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হবে। সরকারি ঋণের তিনটি বড় খারাপ দিক আছে। প্রথমত. এই ঋণ জমা হতে হতে একদিন বহন করার ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাবে অতীতের ঋণের দায় মেটাতে। তখন কি কোনো অর্থমন্ত্রী আদৌ বাজেট মেলাতে পারবেন? পারবেন বড় থেকে বড় অঙ্কের পুনঃঋণ করে। এর অর্থ হবে অর্থনীতি ঋণের এক দুষ্টচক্রে প্রবেশ করবে। অথচ আর্থিক শৃঙ্খলার বিষয়টি কেমন হবে। দ্বিতীয়ত. তখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, শুধু মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করেই অবস্থার সামাল দিতে বাধ্য হবে। এ জন্য উপদেশ হলো সামর্থ্যের মধ্যে চলুন। ঋণ করে ঘি খাওয়ার দরকার নেই। সময় থাকতে ঘাটতি বাজেটের রশি টেনে ধরুন।
সাত. রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ছোট বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি টানতে হচ্ছে। ক্রমে সেই অতি মূল্যের বিদ্যুৎকে জনগণকে বলা হবে তোমরা পূর্ণ মূল্য দিয়ে কেনো। জনগণ বিদ্যুৎ চাইছে। তবে নিশ্চয়ই অতি মূল্যের এই বিদ্যুৎ নয়। আজকে বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে Rent Seeking যেমন হচ্ছে, তেমনি অন্য দুর্নীতি অর্থনীতিকে গ্রাস করতে চলেছে। অনুরোধ থাকবে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের এই সর্বনাশা পদ্ধতি থেকে ফিরে আসুন। যে বোঝা ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে অর্থনীতির ওপর চাপানো হয়েছে, সে বোঝা অর্থনীতির বহনের কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা আছে তার মূল্য দিতে হবে দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের।
শেষ কথা হলো, অর্থনীতিতে যেসব আপদ আজকে জেঁকে বসেছে তার বেশির ভাগই সরকারের ভুল পলিসিরই ফল। অর্থনীতিতে একটা অনাস্থা ও হতাশার ভাব বিরাজ করছে। ভোক্তা দুঃখে আছে, বিনিয়োগকারী দুঃখে আছে, শেয়ারবাজারের লোকজন দুঃখে আছে, সৎ লোকজন দুঃখে আছে। তাহলে এই অর্থনীতিতে কে সুখে আছে?

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.