নিত্যজাতম্-কার শেখার কথা, কে শেখে! by মহসীন হাবিব

গণতন্ত্র কী এবং গণতান্ত্রিক দেশের শাসকদের কেমন হওয়া উচিত তার একটি স্ট্যান্ডার্ড আমাদের চোখের সামনে ভাসে। মুশকিল হলো, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এতটাই পিছিয়ে পড়েছে যে ওই স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করার রাস্তা হারিয়ে গেছে।


আজ যারা সভ্যতা লাভ করেছে, তারা কী করছে আর সব সভ্যতা-ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলে আমরা কোথায় অবস্থান নিয়েছি?
৩১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গিয়েছিলেন হোয়াইট হাউসে। ৪৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে রিপাবলিকান দলের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর স্ত্রীর পোট্রেট উন্মোচিত হয় হোয়াইট হাউসে। সঙ্গে ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের বাবা ও যুক্তরাষ্ট্রের আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ হার্বার্ট ওয়াকার বুশ (যাঁকে আমরা সিনিয়র বুশ বলে চিনি। তিনি এখন হুইল চেয়ারনির্ভর হয়ে পড়েছেন।) এবং মা বারবারা বুশ। সঙ্গে আরো ছিলেন রিপাবলিকান শাসনামলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ স্টাফ ও কমান্ডার। পোট্রেট উন্মোচনের আগে অতিথিরা ডেমোক্র্যাট দলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামার সঙ্গে দুপুরের খাবার উপভোগ করেন। এরপর অত্যন্ত উষ্ণ পরিবেশে হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পোট্রেট উন্মোচিত হয়। সেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বুশকে তাঁর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য (ফর হিজ সার্ভিস) ধন্যবাদ ব্যক্ত করেন। অত্যন্ত রসবোধসম্পন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট একপর্যায়ে বলেন, �We may have our differences politically, but the presidency transcends those differences.�
সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সাধারণত বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানাদিতে থাকেন না। তিনিও ছিলেন বেশ খোশ মেজাজে। একপর্যায়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সহাস্যে পোট্রেটের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, 'শুরু হয়েছে জর্জ ওয়াশিংটনকে দিয়ে এবং শেষও হয়েছে জর্জ ডব্লিউ দিয়ে।' হোয়াইট হাউসে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের পোট্রেটটি ১৮১৪ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধকালে ব্রিটিশদের লুট অথবা পুড়িয়ে দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন তখনকার প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসনের স্ত্রী ডলি মেডিসন। ১৮১৪ সালে ব্রিটিশ মেজর জেনারেল রবার্ট রস তাঁর বাহিনী নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি দখল করে নেন। ব্রিটিশ জেনারেল আদেশ দিয়েছিলেন, জনগণের যেন ক্ষতি না হয়, কিন্তু সরকারি যত ভবন আছে সব ধ্বংস করে দাও।' সেই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসন হোয়াইট হাউস ছেড়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাওয়ার সময় ফার্স্টলেডিকে বলেছিলেন, আর যাই হোক যদি এখান ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাহলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো নিতে ভুলে যেও না। সেটি ছিল ১৮১৪ সালের ২২ আগস্টের ঘটনা। ২৩ আগস্ট ফার্স্টলেডি ডলি মেডিসনকে হোয়াইট হাউস ছেড়ে যেতে হয়। তিনি তখন নিজেদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে রেখে জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেকথা স্মরণে রেখেই জর্জ বুশ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্ত্রী মিশেলের দিকে ফিরে হাসিমুখে বলেছেন, �If anything happens, there�s is your man.� মিশেলও সঙ্গে সঙ্গে উত্তরে বলেছেন, �I promise, I�m going straight for.�
কল্পনা করি; বাংলাদেশে যদি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পোট্রেট রাখার নিয়ম থাকত, তাহলে কী হতো? হলফ করে বলা যায়, সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিল আসত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছবি নামিয়ে ফেলার। কিছুদিন আগে চমৎকার একটি ব্যঙ্গ দেখেছিলাম পত্রিকার সঙ্গে প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে। চীনের প্রেসিডেন্ট ওয়েন জিয়াবাওয়ের সঙ্গে কথা বলছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, 'আপনার নামের মধ্যে জিয়া নামটা ঢুকে গেছে। ওই অংশটি কেটে ফেলতে হবে।' এটি নিরেট হাস্যরস। এর কোনো বাস্তবতা নেই। কিন্তু শুধুই হাস্যরস কী? পৃথিবীর সব মানসম্পন্ন, সৃজনশীল রঙ্গ-ব্যঙ্গই আসলে সমাজের প্রকৃত চেহারারই একটি তীর্যক বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সমাজে একটি বিষয় খুবই চোখে পড়ে। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, যেসব তরুণ-যুবক বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, বোনের গায়ে হাত তোলে, ঘরের ভেতরে অশান্তি করে- এসব ছেলে বাইরে গিয়ে বিড়ালের মতো চুপসে থাকে। বন্ধুদের মধ্যে তাদের বিশেষ প্রাধান্য থাকে না। আর বাইরে যেসব ছেলে সাহসী-প্রতিবাদী বলে পরিচিত থাকে, বাইরে যাদের কণ্ঠ শক্ত, তারা ঘরে ঢোকে মাথা নিচু করে। বাবাকে দেখলে বিড়ালের মতো চুপসে যায়। রাষ্ট্রের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যেও এমনটাই দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সের ইশারায় বহু দেশকে ওঠাবসা করতে হয়। অথচ এসব দেশের সরকারগুলো ঘরের ভেতরে একজন সাধারণ নাগরিকের প্রতিও কোনো সংস্থা দিয়ে শিক্ষা দেওয়ার কথা চিন্তা করে না। সরকার পরিবর্তন হলে এসব দেশে একজন মানুষেরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয় না।
তবে সবকিছুর পরও আশা ছেড়ে দেওয়া যায় না। কিছু মানুষ, কিছু জনপ্রতিনিধির মধ্যে এমন কিছু থাকে যা দেশের মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। তেমনি একজন জনপ্রতিনিধির কথা এ মুহূর্তে বলতে পারি, যিনি আমাকে অতিসম্প্রতি মুগ্ধ করেছেন। তিনি পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মওলা রনি। একজন মানুষ কী চিন্তা করেন, তাঁর চিন্তার উচ্চতা কতটা তা বুঝতে এক ঘণ্টা তাঁর কথা শোনাই যথেষ্ট। মৃদুভাষী, তরুণ এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে আলোচনায় এসেছিলেন একজন একাডেমিক। তিনি নেদারল্যান্ডসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে থাকেন। এই একাডেমিক যা বলতে চেয়েছেন, তার কিছুই বুঝতে পারিনি। তাঁর তাত্তি্বক আলোচনা না বুঝতে পারা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু বুঝতে পেরেছি গোলাম মওলা রনির প্রাণবন্ত অকপট কথাগুলো। অল্প সময়ে তিনি যা বলেছেন তা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ইতিবাচক বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু সে সুযোগ নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিষয়ে বিবিসির কটাক্ষ করা নিয়ে তিনি আক্ষেপ করে মোটামুটি এ রকম বলেছেন, 'নানা কারণে সাময়িকভাবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি এটা ঠিক। কিন্তু এ দেশের মানুষের পশ্চিমা বিশ্ব বা বিবিসির কাছে নতুন করে গণতন্ত্র শেখার কিছু নেই।' তারপর তিনি ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইতিহাসের হাফেজের মতো ব্যাখ্যা করেছেন। মুগ্ধ হয়েছি, ভীষণ আনন্দিত হয়েছি বর্তমান বাংলাদেশে একজন তরুণ সংসদ সদস্যের ইতিহাস জ্ঞানের গভীরতা, সমাজ মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা, রাজনৈতিক বিষয়ে দূরদৃষ্টি দেখে। সত্যিই তো! ৫০ বছর বা ১০০ বছরের বন্ধ্যত্ব আমাদের দুর্ভাগ্যজনকভাবে সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু হাজার হাজার বছরের আলোকে কী শিখব আমরা? অষ্টম শতাব্দীর ঠিক মাঝামাঝি সময় বৌদ্ধ রাজা গোপাল ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন। এর আগে এথেন্সে গণতন্ত্রের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছু ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সর্দার বা রাজা নির্বাচিত হয়েছে বটে, কিন্তু বাংলায় গোপাল যে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তার নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই উপমহাদেশে নালন্দা, তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয় যখন সৃষ্টি হয়েছে, তখন বর্তমান অনেক সভ্য বলে পরিচিত দেশেরই কোনো অস্তিত্ব ছিল না। নালন্দা কী ছিল? দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কিরা যখন ভারতবর্ষ দখল করে, তখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, সে লাইব্রেরি এত সমৃদ্ধ ছিল যে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর তা সম্পূর্ণ পুড়ে যেতে তিন মাস সময় লেগেছিল। তাই বলছি, আজ কার শেখার কথা, কে শেখে!
ইতিহাস সচেতন রনি অকপটে বলেছেন দেশের সার্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক মান ও রাজনৈতিক নানা অসংগতির কথা। তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, আজ যিনি আমাদের যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার, তিনি ম্যাগনা কার্টা সম্পর্কে কিছু বলতে বা লিখতে পারবেন না, যিনি চীনের রাষ্ট্রদূত তিনি মিং রাজবংশ নিয়ে ২০০০ শব্দের একটি রচনা লিখতে পারবেন না। অথচ পশ্চিমারা যাঁদের এখানে রাষ্ট্রদূত করে পাঠাচ্ছেন, তাঁদের এ দেশ, এ দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দিয়ে পাঠাচ্ছেন। এখানেই আসলে পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, যারা আমার পাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করে, তারা ধান্ধাবাজ। যাঁরা সমাজের প্রকৃত শিক্ষিত ও সজ্জন তাঁরা কখনোই আমাদের কাছে আসেন না। দূরে থাকেন। ওই মানুষগুলোকে আমরা খুঁজে বের করে আনতে পারলেই আমাদের রাজনীতি সার্থক হবে। ধন্যবাদ সংসদ সদস্যকে এ উপলব্ধির জন্য। এ উপলব্ধির এখন খুবই আকাল।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.