সাময়িক প্রসঙ্গ-জাতিকে উদ্ধারের দায়িত্ব by তারেক শামসুর রেহমান

শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র শেখায় সহনশীলতা। গণতন্ত্র শেখায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথা। একদলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি এ পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের সুফলকে সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে পারিনি সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।


গত ১২ জুলাই হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ সরকার ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, 'দয়া করে জাতিকে উদ্ধার করুন। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে জাতি উদ্বিগ্ন। এই সংকটপূর্ণ অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি চায়। মুক্তি দিন।' বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিন আবেদনের সময় হাইকোর্ট এ মন্তব্যটি করলেন। বিচারপতি নুরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আনোয়ারুল হককে নিয়ে ওই বেঞ্চটি গঠিত। বিচারপতিদের এ মন্তব্যই বলে দেয় দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন। একদিকে সরকারের কঠোর মনোভাব ও অন্যদিকে বিরোধী দলের সরকার পতনের আন্দোলন দেশকে এক কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' বা আস্থার রাজনীতির কথা বলে, তা বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নেই। সরকার ও বিরোধী দল এখন পরস্পরবিরোধী একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে, যা আমাদের ২০০৬ সালের অক্টোবরের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় মাত্র।
মাননীয় বিচারপতিদ্বয়ের এ মন্তব্যটিকে আমি বেশি করে গুরুত্ব দিতে চাই। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। রোজা শুরু হওয়ার এখনও কিছুদিন বাকি। কিন্তু প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী। তেল, চাল, চিনি কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। কাঁচাবাজার এখন রীতিমতো আতঙ্ক। ৪০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না কোনো শাকসবজি। অথচ এ জায়গাটিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থতা সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দেশের সংবিধান, ভবিষ্যৎ নির্বাচন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল যখন নূ্যনতম ঐকমত্যে পেঁৗছতে পারছে না, তখন দেশের অর্থনীতির যে চিত্র আমরা পাই, তা কোনো আশার কথা বলে না। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আটার দাম বেড়েছে প্রায় ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ১১৮ দশমিক ৩৬ ভাগ ও ১৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। ২০১০-১১ অর্থবছরের শুরু থেকেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর অতিক্রম করে। ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সার ও ডিজেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষদের একটা বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ায় এমডিজির বাস্তবায়ন (২০১৫ সালের মধ্যে) এখন প্রশ্নের মুখে। রেমিট্যান্স আয়ের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ শতাংশ। অথচ এর আগের বছরে (২০০৯-১০) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি। বিদেশে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়েও সমস্যা রয়ে গেছে। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০১১ সালে জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ১৯৪ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ যুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬৩০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, (৫ জুলাই) ২০০৪ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো, এখনও সে পরিমাণ বিদ্যুৎই উৎপাদন হচ্ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। এর মাঝে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। পুলিশের পিটুনিতে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি এখন নিউইয়র্কে। জয়নাল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে পুলিশের কী লাভ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পুলিশ অত্যাচারের ওই ছবি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বে, যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশের এই 'অতি বাড়াবাড়ি'র সমালোচনা না করে সমর্থন করলেন। অতীতেও পুলিশ প্রায় একই ধরনের 'কাণ্ড' করেছে। পুলিশের জন্য একটি 'কোর্ড অব কনডাক্ট' প্রণয়ন করা বোধহয় জরুরি হয়ে পড়েছে। মিডিয়ায় দুই পুলিশ অফিসার 'অভিযুক্ত' হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না কোনো অবস্থাতেই। এই যখন পরিস্থিতি, তখন যে প্রশ্নটি জরুরি_ তা হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। দেশের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তনের ফলে একটা আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
অনেকগুলো ইস্যুতে (রাষ্ট্রধর্ম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, মৌলিক কাঠামো) খোদ মহাজোটের শরিকদের মাঝেও বিভক্তি রয়েছে। মহাজোটের শরিকরা (ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাপ) পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিশেষ কমিটির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও প্রকারান্তরে তারা তাদের দ্বিমতের কথা জানিয়েছে বিভিন্ন সেমিনারে। এদিকে ড. কামাল হোসেন বলেছেন সংবিধানে ১৬তম সংশোধনী আনার। সব মিলিয়ে সমঝোতা কী ভাবে সম্ভব তা এক বড় প্রশ্ন এখন। সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পরও সরকার বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বিরোধী দলের উচিত, সরকারের এই বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্যতায় নিয়ে তাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করা। এতে করে অন্তত সংসদে একটি রেকর্ড থাকল। সরকার যদি তাদের প্রস্তাব নাও মানে, বিরোধী দলের প্রস্তাবাবলি বিবেচনায় নিয়ে একটি আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। যেহেতু সংসদ কার্যকর, সেহেতু সংসদে এসে প্রস্তাব দেওয়ার মধ্য দিয়ে সংসদীয় রাজনীতির ধারাকে আমরা আরও শক্তিশালী করতে পারি।
যে জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল, সেই জনপ্রিয়তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর তাৎপর্য যতটা না বেশি, তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। বিশ্ব অর্থনীতির উত্থান-পতন তারা বোঝেন না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল কি কমল, এতে তাদের কিছু যায় আসে না। টাকার মান কমে গেলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়ে, এটাও তারা বোঝেন না। তারা চান জিনিসের দাম কম থাকুক। চালের দাম কমে যাক। কমুক তেলের দাম। সরকার যদি এদিকে দৃষ্টি দিত, বোধকরি এটা সরকারের জন্য ভালো হতো। মানুষের তো সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা অনেক। ওএমএসের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এদিকে দৃষ্টি দেন কি-না জানি না। দেশে কতসংখ্যক লোক দরিদ্রতার নিচে বসবাস করে, এর একটা পরিসংখ্যান আছে। এর জন্য কিছু লোকও রয়েছেন, যারা এসব পরিসংখ্যান তৈরি করে দেন। কিন্তু কেউ কি জানেন 'ছদ্মবেশী দরিদ্রের' সংখ্যা বাংলাদেশে কত? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা অংশ দরিদ্রতার নিচে চলে গেছে। সীমিত আয়ে তাদের আর সংসার চলে না, চালানো যায় না। ওদের নিয়ে কেউ ভাবে না।
শুধু নির্বাচনের নামই গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্র শেখায় সহনশীলতা। গণতন্ত্র শেখায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখার কথা। একদলীয় সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের স্পিরিটের পরিপন্থী। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি এ পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আমরা গণতন্ত্রের সুফলকে সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে পারিনি। উচ্চ আদালত যে মন্তব্যটি করেছেন তা যদি আমরা বিবেচনায় নিই তাহলে তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
www.tsrahmanbd.blogspot.com
 

No comments

Powered by Blogger.