বিশেষ সাক্ষাত্কার-খোলামেলা আলোচনার ভিত্তিতেই আমরা এগিয়ে যাব by ডা. দীপু মনি

জন্ম ঢাকায়, বড়ও হয়েছেন ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস চাঁদপুরে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। হলিক্রস স্কুল ও কলেজ থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি ও পরে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস। যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে মাস্টার্স।


তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে এলএলএম করেছেন। জন্স হপকিন্স ও হার্ভার্ডে বিশেষ পাঠক্রম ‘নেগোশিয়েশন অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রেজুলেশন’ বিষয়েও তিনি অধ্যয়ন করেন। একাধারে চিকিত্সক, জনস্বাস্থ্য পেশাজীবী, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ছোটবেলা থেকে জনসেবা তাঁর জীবনের ব্রত। সেই সূত্রে পেশাগত আদর্শ হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ। বিগত নির্বাচনে তিনি চাঁদপুর সদর ও হাইমচর নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনিই দেশের প্রথম নারী, যিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন আব্দুল কাইয়ুম
প্রথম আলো  প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে প্রাপ্তির আশা কতটা? বাংলাদেশের অগ্রাধিকারগুলো কী?
ডা. দীপু মনি  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকে শুধু প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিবেচনায় সীমিত রাখা যায় না, আরও বড় পরিসরে বিষয়টিকে দেখতে হবে। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের পর্যায়ে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই মূল বিষয়। অন্যতম অগ্রাধিকার হলো ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন। এর মধ্যে প্রথমে আসবে তিস্তার পানি। গঙ্গার পানিবণ্টনের চুক্তি আছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য নদীর পানিবণ্টনের বিষয়েও আলোচনা এগিয়ে নিতে চাই। তা ছাড়া আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক সম্প্রসারণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্কবহির্ভূত বাধাগুলো দূর করা। দুই দেশের পণ্যের মান নির্ধারণী-প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধনের ব্যাপারটিও রয়েছে। আমরা চাচ্ছি, দুই দেশ শুধু নয়, পুরো অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ (কানেকটিভিটি) এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে আমাদের কিছু অমীমাংসিত বিষয় আছে, সেগুলো আলোচনায় আসবে। যেমন—আমাদের সীমানা নির্ধারণ, নিরাপত্তার দিক থেকে আমাদের সহযোগিতা প্রভৃতি।
প্রথম আলো  আপনি নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা বললেন। ভারত তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গ্রেপ্তারের পর ভারত কি বাংলাদেশের সহযোগিতার ব্যাপারে আস্থাশীল হয়েছে?
ডা. দীপু মনি  দেখুন, দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি খুব জরুরি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক যেমন বিশ্বাস ও আস্থার ওপর নির্ভর করে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সে রকম। আমাদের বর্তমান অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সরকার, তার নির্বাচনী ইশতেহারে যে কথা বলেছে, সে অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছি। আমরা কথায় ও কাজে প্রমাণ করেছি যে অন্য কোনো দেশের ওপর আক্রমণ করা, তাদের ক্ষতি করা বা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে—এ রকম কিছু করার জন্য বাংলাদেশের কোনো ভূমিকে আমরা ব্যবহার করতে দেব না। এবং আমার মনে হয়, এই বিষয়গুলো নিশ্চয়ই আস্থার সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে।
প্রথম আলো  নেপাল ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্যে ভারতের ট্রানজিট দেওয়ার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, এ বাণিজ্য কি শুধু দুই দেশের মধ্যেই? তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য নেপাল-ভুটানকে কি এই ট্রানজিট ব্যবহার করতে দেওয়া হবে?
ডা. দীপু মনি  এখন শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের জন্য নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ভারতের মধ্য দিয়ে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ব্যবস্থাটি নেই। সেটি আমাদের আলোচনার মধ্যে থাকবে; যেন নেপাল-ভুটান তৃতীয় দেশে বাণিজ্যের জন্য আমাদের মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারে।
প্রথম আলো  ভারত তো ট্রানজিট দেবে, বিনিময়ে আমরা কী দিচ্ছি?
ডা. দীপু মনি  দেখুন, এটি তো কানেকটিভিটির একটি সামগ্রিক প্রশ্ন। আমরা যেমন নেপাল-ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা পাব, তেমনি ভারতেরও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বা নিজের দেশেরই একটি অংশ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের প্রশ্ন রয়েছে। এটা আলোচনায় আসবে। এতে তো শুধু বাংলাদেশ বা শুধু ভারত নয়, পুরো অঞ্চলই উপকৃত হবে। আমরা কী দিচ্ছি, তারা কী দিচ্ছে—এভাবে বিষয়টি দেখা ঠিক হবে না। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়বে, পুরো অঞ্চলে সমৃদ্ধি আসবে এবং আমাদের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
প্রথম আলো  তার মানে, এ সফরের মধ্য দিয়ে শুধু দু-একটি চুক্তিই নয়, একটি বড় আঙ্গিকে সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হতে যাচ্ছে?
ডা. দীপু মনি  নিশ্চয়ই। গত এক বছরে পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়ন লক্ষ করুন। আমরা যে একটি শান্তির দেশ হিসেবে এবং বিশেষভাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাই, তার প্রমাণ কিন্তু বাংলাদেশ গত এক বছরে রেখেছে। পুরো এলাকায় যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। সড়ক, রেল ও নদীপথ, যোগাযোগের সব মাধ্যম আমরা স্থাপন করতে চাই এই পুরো অঞ্চলে।
প্রথম আলো  সীমানা চিহ্নিতকরণের কথা আপনি বলেছেন। কিন্তু সীমানা নিয়ে তো আরও অনেক সমস্যা। ছিটমহল, অপদখলীয় এলাকার বিষয়গুলো নিয়ে কি আলোচনা হবে?
ডা. দীপু মনি  হবে, নিশ্চয়ই হবে। দেখুন, সরকার গঠনের পর এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর। দুই দেশের মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সুসম্পর্ক রয়েছে, সেসব কিছু বিবেচনায় এ সফরটি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, দুটি সীমান্তসংলগ্ন পাশাপাশি দেশের মধ্যে যত সমস্যা আছে, তার সবকিছু এক সফরেই সমাধান হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের মধ্যে সব বিষয় নিয়েই খোলামেলা আলোচনা হবে এবং তার ভিত্তিতেই আমরা এগিয়ে যাব।
প্রথম আলো  আমাদের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিক মারা যায়। সম্প্রতি সীমান্তে এক বাংলাদেশি কিশোরীকে মেরে ফেলা হয়েছে। এর প্রতিকার কী?
ডা. দীপু মনি  এটা খুবই দুঃখজনক। আপনারা জানেন, এসব বিষয় নিয়ে সব সময় দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। একটি সমাধানের দিকে যাওয়ার জন্য দুই দেশের সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও সংযম প্রদর্শন, আরও আলোচনা ও দুই পক্ষের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান আরও নিয়মিত করা দরকার। আলোচনায় সব বিষয়ই আসবে।
প্রথম আলো  টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে ভারত বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া ওরা কিছু করবে না। তাদের এই আশ্বাসের ওপর আমরা কতটা ভরসা রাখতে পারি?
ডা. দীপু মনি  আন্তর্জাতিক আইনে একটি রাষ্ট্র আরেকটি রাষ্ট্রকে যখন বলে, তোমাদের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করব না, সেটি কিন্তু তখন অন্য রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। কারণ, এটি আন্তর্জাতিক আইনে প্রতিষ্ঠিত একটি নীতি, যাকে বলা হয় ‘নো হার্ম প্রিন্সিপল’ (ক্ষতি না করার নীতি)। এবং সেটির ভিত্তিতে যখন একটি রাষ্ট্র আশ্বাস দেয়, আমরা সেটি বিশ্বাস করি। তবে বিষয়টি আবারও আমরা উত্থাপন করব, আলোচনা করব। আমরা বিশ্বাস করি, ভারত বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না।
প্রথম আলো  আচ্ছা, বলুন তো, সমুদ্রসীমা নিয়ে আমরা যে সালিসিতে গেলাম, এরপর কি আর এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ আছে?
ডা. দীপু মনি  হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে। আমরা বলেছি, শুধু একটি নয়, দুটি দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। একটি দেশের সঙ্গে ২২ বছর, আরেকটি দেশের সঙ্গে ২৬ বছর কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বন্ধ ছিল। ২০০৮ সালে সে আলোচনা আবার শুরু হয়। এবং এই আলোচনার মধ্যেই মিয়ানমার ও ভারত বঙ্গোপসাগর উপকূলে তাদের মহীসোপানের দাবি উত্থাপন করেছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে, সেই মতামত আমরা জানিয়েছি। এবং একই সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধানে যাওয়ার লক্ষ্যে একদিকে আলোচনা যেমন চালিয়ে যাব, আরেকদিকে দ্বিতীয় উপায় হিসেবে আমরা সালিসির ব্যাপারে তাদের নোটিশ দিয়েছি। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের ব্যাপারে আমরা সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিষয়টি পাঠিয়েছি। আর ভারতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে। আমরা কিন্তু আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান চাই। সমুদ্রের তলদেশে তিন দেশের প্রাপ্য যে সম্পদ রয়েছে, তার ওপর বাংলাদেশের সঠিক ও ন্যায্য পাওনার দাবি প্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য। এ জন্য একদিকে যেমন আলোচনা চালিয়ে যাব, অন্যদিকে আলোচনার মাধ্যমে আমরা যদি লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে যেন আরেকটি পথ খোলা থাকে, সে ব্যবস্থাও করেছি।
প্রথম আলো  কিন্তু সালিসিতে যাওয়ায় কি আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি হলো না?
ডা. দীপু মনি  না, তা কেন হবে। এ ধরনের সমুদ্রসীমা নিয়ে আপত্তি বা মতভেদের ক্ষেত্রে, আলাপ-আলোচনার পথে সমাধান না হলে বিকল্প হিসেবে সালিসিতে যাওয়ার বিধান সমুদ্র আইনের কনভেনশনেই আছে। আমরা বিশ্বাস করি, সালিসিতে যাওয়া সত্ত্বেও পাশাপাশি আলাপ-আলোচনা চলবে। শুধু সমুদ্রসীমাই নয়, এই দুটি দেশের সঙ্গে আরও অনেক বিষয়ে আমাদের যে যোগাযোগ, আলাপ-আলোচনা ও সহযোগিতা, সেগুলো নিয়ে আমরা এগিয়ে যাব। আমরা বিশ্বাস করি, সেসব ক্ষেত্রে এ বিষয়টি কোনোভাবেই কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।
প্রথম আলো  আমরা দেখছি, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব থেকে আমাদের শ্রমিক ফেরত আসছেন। এর পেছনে কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?
ডা. দীপু মনি  স্বাভাবিক ধারাতেই কিছু শ্রমিক ফিরে আসেন। কারণ, কাজের মেয়াদ শেষ হলে তাঁদের ফিরে আসতে হয়। অবশ্য কারও কাগজপত্র ঠিক থাকে না বা প্রতারিত হন বলে ফিরে আসেন। এই ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক সংখ্যা নয়। শ্রমিক যেমন ফেরত আসছেন, তেমনি আবার যাচ্ছেনও। আপনি যদি আসা-যাওয়া মিলিয়ে হিসাব করেন, তাহলে কিন্তু দেখবেন, অন্যান্য সময়ের মতোই প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় আছে আমাদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ। তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবও কিছুটা পড়েছে। কারণ, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রধানত নির্মাণশিল্পেই কাজ করেন। আর এই খাতটিই বিশ্বমন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশে শ্রমিক পাঠানো নিয়ে প্রতারণাও করে। ফলে প্রবাসে শ্রমিকদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আমরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান, অভিবাসন-ব্যয় কমানো, শ্রমবাজার ধরে রাখা ও সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
প্রথম আলো  আর কোনো সমস্যা আছে কি না? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো দেশ কি অসন্তুষ্ট?
ডা. দীপু মনি  আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো দেশের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি উত্থাপিত হয়নি। বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অপরাধকে সমর্থন করতে পারে না।
প্রথম আলো  আপনি খুব ঘন ঘন বিদেশ সফরে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
ডা. দীপু মনি  দেখুন, আমি তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমার কাজ হলো, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করা এবং সেসব দেশে আমাদের স্বার্থ তুলে ধরা। অনেক কাজ আছে—আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, এমনকি মানুষে মানুষে যোগাযোগ; সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাড়ানোর কাজও কম নয়। এতগুলো কাজ করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে যেতে হয়, সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে হয়। এ জন্য অন্য মন্ত্রীদের চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনেক অনেক বেশি বিদেশ সফর করতে হয়। এটি কিন্তু যেকোনো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্যই প্রযোজ্য। আর আমি বলব যে বিশেষভাবে গত এক বছরে আমাদের হয়তো একটু বেশি বিদেশ সফরে যেতে হয়েছে। কারণ, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, দুঃশাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন এবং লুটপাটের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। পরের দুই বছরে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের স্থবিরতা এসেছিল। এ অবস্থায় এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার যেমন প্রয়োজন ছিল তেমনি আবার নেতিবাচক পরিচয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের সঠিক পরিচয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল।
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে জঙ্গিবাদের স্থান নেই, সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের অবস্থান। মানবাধিকারের পক্ষে, নারীর অধিকারের পক্ষে মানুষের অবস্থান। এসব বিশ্বের কাছে আমরা তুলে ধরতে পেরেছি। এবং এ জন্য বিদেশ সফর করতে হয়েছে। তা ছাড়া এ বছর কিন্তু অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে। যেমন: কমনওয়েলথ, ন্যাম, খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে এফএও সম্মেলন—সব কটি এই একই বছর ২০০৯-এ এসে পড়েছে। তারপর ছিল কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। এ সম্মেলনের পটভূমিতে বিভিন্ন দেশে অনেকগুলো সম্মেলন বা আলোচনা-সমাবেশ হয়েছে। সেগুলোতে অংশগ্রহণ না করলে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কী করে দায়িত্ব পালন করতাম, বলুন তো? এই সার্বিক বিবেচনায় বলা চলে, বিদেশ সফর অযৌক্তিক তো নয়ই, অস্বাভাবিকও নয়; বরং অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
প্রথম আলো  আচ্ছা, দেখুন, রাষ্ট্রদূতের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিধান থাকলেও এবার তা ছাড়িয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এটা কি ঠিক হলো?
ডা. দীপু মনি  চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যাপারটা কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়; বিশেষভাবে রাষ্ট্রদূতের ক্ষেত্রে এ রকম সব দেশেই ঘটে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জনবল নিয়োগ কয়েক বছর ধরে কম হয়েছে। এমনিতেই আমাদের জনবলকাঠামো খুবই অপ্রতুল, তার ওপর কিছু শূন্য পদ রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যেতে হয়েছে।
প্রথম আলো  আরেকটি বিষয় লক্ষ করার মতো। ওয়াশিংটন, লন্ডন ও দিল্লিতে নিয়োজিত রাষ্ট্রদূতদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আগে এ রকম দু-একটি ক্ষেত্রে হয়েছে বটে, কিন্তু এত বেশি ছিল না। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
ডা. দীপু মনি  মরহুম আবু সায়ীদ চৌধুরী, ড. এ আর মল্লিক, এম আর সিদ্দিকীর মতো ব্যক্তিরা রাষ্ট্রদূত হিসেবে গিয়েছেন। বর্তমানের এই কয়েকজনের ব্যাপারে বলা যায়, তাঁদের যে দেশগুলোতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের গুরুত্ব এবং নিয়োজিত ব্যক্তির অভিজ্ঞতা—এই উভয় বিবেচনায় তাঁদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাঁরা অত্যন্ত অভিজ্ঞ। দুজন তো ফরেন সার্ভিসেরই (কূটনৈতিক পেশা), অপরজনও তাঁর নিজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও বরেণ্য।
প্রথম আলো  যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটা?
ডা. দীপু মনি  যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তো সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। দুটি ছোট্ট উদাহরণ দিই। এই যে জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে কথা বলছেন, হিলারি ক্লিনটন যে আমাকে ফোন করছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনা হলো, যৌথ সংবাদ সম্মেলন হলো—এ সব কটি মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুণগত উন্নয়ন ঘটেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কও ভালো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রীর ইতিমধ্যেই বেশ কবার আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। আমরা এ দেশ দুটির সঙ্গে সম্পর্ক নতুন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। ওদের দিক থেকেও আমরা ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি।
প্রথম আলো  ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন কি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে?
ডা. দীপু মনি  আমি সে রকম মনে করি না। কারণ, বর্তমান বিশ্বে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, তাতে এ দেশগুলোর সঙ্গে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পথেই আমরা যাচ্ছি। আমি মনে করি, এক দেশের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে আরেক দেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টির কোনো কারণ নেই। এখন কিন্তু বিশ্ব আর অতীতের সেই ভাগাভাগির মধ্যে নেই। এই শিবির না ওই শিবির—এসব কিন্তু এখন অর্থনৈতিক কারণেই বলেন বা বিশ্ব জলবায়ুর চ্যালেঞ্জের কারণেই বলেন, আগের মতো করে আর বিবেচিত হয় না। এখন বহু দেশের সঙ্গে বহুমাত্রিক সম্পর্ক একই সঙ্গে চলে। আমরা সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতে চাই এবং সবার কাছ থেকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। তা ছাড়া ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। চীনও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। বর্তমানে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক স্বার্থেই এ দেশগুলো তা করছে। বাংলাদেশের জন্যও সেই একই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতার সম্পর্কগুলো অপরিহার্য।
প্রথম আলো  আপনাকে ধন্যবাদ।
ডা. দীপু মনি  ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.