রেভারেন্ড এডওয়ার্ড আইয়ুব-ইস্টার সানডে

পুণ্য শুক্রবার ও পুনরুত্থান দিবসে ঈসার দাবি আমাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ। ঈসায়ী ধর্মে ঈসার মৃত্যু ও পুনরুত্থান_উভয়ই বড় ঘটনা। ঈসা তাঁর মৃত্যুর আগেই বলেছিলেন, তিনি মারা যাবেন। তিনি কিভাবে মারা যাবেন, মৃত্যুর উদ্দেশ্য, কার হাতে মারা যাবেন, কে তাঁকে ধরিয়ে দেবেন এবং তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব দিক তিনি আগাম বলে দিয়েছিলেন।


আর তা পরিপূর্ণ ও কার্যকর হয়েছে। ঈসা মারা গিয়েছেন বলার মধ্য দিয়ে তাঁর মৃত্যুর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে তুলে ধরছেন। ঈসা বলছেন, পুনরুত্থানের কারণে তিনি চিরকাল জীবন্ত। তিনি মৃতদের মধ্য থেকে প্রথম পুনরুত্থানকারী। এর অর্থ, তিনি মৃত্যুকে চিরতরে পরাজিত করেছেন। কেননা পৃথিবীতে যত সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর মূল এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মৃত্যু। মানুষ যতই শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান হোক না কেন, মৃত্যুকে সবাই ভয় করে। আর মৃত্যুর কাছে সবাই পরাজিত।
ঈসা বলেন, 'আমি যুগ পর্যায়ের যুগে যুগে জীবন্ত।' পুনরুত্থান ও জীবন পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়। মানুষ মারা যায়, কিন্তু ঈসা মসিহের দ্বিতীয় আগমনের সঙ্গে সঙ্গে তারা আবার মৃত্যু থেকে উঠবে। এরপর আর কোনো মৃত্যু নেই। ঈসা মসিহ যে মৃত্যুবরণ করেছেন, তা গুনাহগারদের পক্ষে শাস্তি হিসেবে বরণ করেছেন। গুনাহের শাস্তি মৃত্যু। তিনি নিজে গুনাহমুক্ত, কিন্তু আমাদের গুনাহ বহন করে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। যেহেতু তিনি মৃত্যু থেকে উঠেছেন, তাঁর আর কোনো মৃত্যু নেই। মৃত্যু থেকে উঠে আসা শয়তান ও মৃত্যুর শক্তির বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছেন। তিনি নিজেকে জীবন্ত বলার কারণ হচ্ছে, তিনি মৃত্যুকে পরাজিত করেছেন। তিনি তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তেমনি তাঁর পুনরুত্থানের ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
ঈসা মসিহ যুগে যুগে জীবন্ত বলেই তিনি নিজ সম্পর্কে বলেছিলেন, 'যিনি আছেন ও যিনি ছিলেন ও যিনি আসছেন, যিনি সর্বশক্তিমান।' (ইঞ্জিল শরিফ প্রকাশিত কালাম, ১ : ৮)। এ আয়াতে 'আছেন' বলা হয়েছে। এই 'আছেন' শব্দটি দ্বারা পুরনো নিয়মে আল্লাহর নাম প্রকাশ পেয়েছে। তাওরাত শরিফ, হিজরত, ৩ : ১৪ আয়াতে রয়েছে, "আল্লাহ মূসাকে বললেন, 'আমি যে আছি, সেই আছি।' আরো বললেন, 'ইসরাইল-সন্তানদের এরূপ বলবে, আছি, তোমাদের নিকট আমাকে প্রেরণ করেছেন'।" এখানে 'আছি', যার হিব্রু হচ্ছে 'ইয়েউয়ে'। সে জন্য কিতাবুল মুকাদ্দাসে আল্লাহর নাম হচ্ছে 'ইয়েউয়ে'। এর আরো অর্থ হতে পারে। যেমন_'আমি আছি', 'আমি যে আছি, সেই আছি', 'আমি যে আছি, সে হব'। ঈসা নিজেকে ইয়েউয়ে বলে দাবি করছেন। সে জন্যই ইঞ্জিল শরিফে তাঁকে 'প্রভু' বলা হয়েছে। তাওরাত শরিফে মাবুদ আল্লাহর সদাসর্বদা অবস্থান ও অস্তিত্বকে ঈসা মসিহ তাঁর দাবি, ক্ষমতা ও কাজ দিয়ে প্রমাণ করেছেন। ঈসা মসিহ বেহেশতে যাওয়ার আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'আর দেখো, আমিই যুগান্ত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছি।' (ইঞ্জিল শরিফ, মথি, ২৮ : ২০)। ইবরানি, ১৩ : ৫-৬ আয়াতে লেখা রয়েছে, "...কারণ তিনিই বলেছেন, আমি কোনোক্রমে তোমাকে ছাড়ব না, ও কোনোক্রমে তোমাকে ত্যাগ করব না।" অতএব, আমরা সাহসপূর্বক বলতে পারি, 'প্রভু আমার সহায়, আমি ভয় করব না; মানুষ আমার কী করবে?'
তাঁর চিরকাল জীবিত থাকা আরেকটি বিষয় পরিষ্কার করেছে, আর তা হচ্ছে, ঈসা মসিহ আবার আসবেন। তাই তিনি বলেন, 'দেখো, আমি শিগগিরই আসছি।' (ইঞ্জিল শরিফ প্রকাশিত কালাম, ২২ : ১২)। তিনি মৃতদের থেকে জীবিত হয়ে চিরকাল জীবন্ত আছেন বলেই তাঁর পক্ষে আবার এই পৃথিবীতে আসা সম্ভব। তাঁর জীবন্ত অবস্থা তাঁর দ্বিতীয় আগমনের জন্য যোগ্যতা।
ঈসা মসিহের এই দাবিতে তাঁর আরেকটি স্বভাব ফুটে ওঠে। আর তা হচ্ছে, তাঁর কোনো পরিবর্তন নেই। নবী ইসাইয়ার কিতাব, ৪৩ : ১৩ আয়াতে তিনি বলেন, 'এই দিবস থেকেও আমিই তিনি।' ইঞ্জিল শরিফ ইবরানি, ১৩ : ৮ আয়াতে রয়েছে, 'ঈসা মসিহ কাল ও আজ এবং অনন্তকাল যে, সে-ই আছেন।' ঈসার এই অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য থেকে মানুষ শিক্ষা নিতে পারে, যেন তাদের কথা ও প্রতিজ্ঞার কোনো পরিবর্তন না হয়।
ঈসা মসিহের চিরকাল জীবিত থাকার কারণে তিনিই অনন্তকালীন যাজকত্ব লাভ করেছেন। ঈসা মসিহই পারেন গুনাহগার মানুষকে উদ্ধার করতে। সে জন্য ইঞ্জিল শরিফ, ইবরানি, ৭ : ২৩-২৫ আয়াতে রয়েছে, "আর তারা অনেক যাজক হয়ে আসছে, কারণ মৃত্যু তাদের চিরকাল থাকতে দেয় না। কিন্তু তিনি 'অনন্তকাল' থাকেন, তাই তাঁর যাজকত্ব অপরিবর্তনীয়। এ জন্য, যারা তাঁকে দিয়ে আল্লাহর নিকটে উপস্থিত হয়, তাদের তিনি সম্পূর্ণরূপে নাজাত করতে পারেন। কারণ তাদের নিমিত্তে অনুরোধ করণার্থে তিনি জীবিত আছেন।" কিতাবের এ কথার আলোকে বলা যায়, ঈসা মসিহের আগেকার সব নবীর যাজকীয় কাজ ঈসার যাজকীয় কাজের নমুনা। নবী ও যাজকগণ ঈসা মসিহের চূড়ান্ত যাজকত্বকেই প্রকাশ করেছেন। যাজকদের কাজ হচ্ছে গুনাহগার মানুষের পক্ষে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করা এবং কোরবানি উৎসর্গ করা। যাজকত্বকাল থেকেই যাজকরা আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছেন। আর তাই কিতাবে এমন কথাও রয়েছে, 'কারণ একমাত্র আল্লাহ আছেন; আল্লাহ এবং মানুষের মধ্যে একমাত্র মধ্যস্থও আছেন। তিনি মানুষ, মসিহ ঈসা, তিনি সবার জন্য মুক্তির মূল্যরূপে নিজেকে প্রদান করেছেন।' (১ তিমথীয়, ২ : ৫)
এ ধরনের দাবি বর্তমানের জন্য কতটা প্রযোজ্য? প্রথমত, আল্লাহর কালাম এবং ঈসার পক্ষে সাক্ষ্য বহনের জন্য মণ্ডলী নির্যাতিত হচ্ছে (ইঞ্জিল শরিফ প্রকাশিত কালাম, ১ : ৯)। ঈসার এই শিক্ষা থেকে মণ্ডলী স্থির থাকতে উৎসাহিত হয়। দ্বিতীয়ত, মণ্ডলী নিশ্চিত থাকতে পারে, ঈসায়ী ইমানের জন্য কেউ কেউ মারা গেলেও তারা আসলেই মারা যাবে না। কেননা তারা আবার পুনরুত্থিত হবে এবং চিরকাল বেঁচে থাকবে। বরং ঈসা মসিহ তাদের জীবন-মুকুট দেবেন। (ইঞ্জিল শরিফ প্রকাশিত কালাম, ২ : ১০)। তৃতীয়ত, কিতাবুল মুকাদ্দাসের শিক্ষা দিয়ে নির্যাতিত ঈসায়ীদের পরস্পরকে উৎসাহী করা দরকার। চতুর্থত, তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে যেন কোনো সন্দেহ ও প্রশ্ন কেউ না রাখে। পঞ্চমত, ঈসা তাঁর ক্ষমতা, প্রতিজ্ঞা ও স্বভাবে অপরিবর্তনীয়, আল্লাহর কাছে মানুষের পক্ষে অনন্তকালীন যাজক এবং আল্লাহ ও মানুষের মধ্যস্থতাকারী।

লেখক : পালক ও শিক্ষক, ayub1163@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.