লাল-সবুজের আন্তর্জাতিক মর্যাদা by অজয় দাশগুপ্ত

লাল-সবুজ নিয়ে অন্তহীন গর্ব আমাদের। হওয়ারই কথা। দুনিয়ায় কয়টি জাতি আছে, যারা মাটির সবুজকে অন্তর ও রক্তের রঙে লাল করতে পেরেছে? সে এক আশ্চর্য, অদ্ভুত সময়। কিন্তু সেটাই কি শেষ কথা? লাল-সবুজের পরিচয়, পরিচয় প্রতীক এবং জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে আমরা এখন কোথায়? আমাদের পাসপোর্টটিও সবুজ।


হাতে নিলে এক টুকরো বাংলাদেশ স্পর্শের মতো সুখানুভূতি জানাতে চায়। দিনে দিনে তার শরীরে লাগছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হস্তলিপি এখন দুনিয়া থেকেই নির্বাসনে। ফলে পৃথিবীর আধুনিক এয়ারপোর্ট বা অন্যান্য বন্দরের মেশিনে পড়তে পারার মতো প্রযুক্তি চাই, প্রয়োজন যন্ত্র পাঠযোগ্য ইলেকট্রনিক মুদ্রণ, তাও শুরু হয়েছে। তাতেই কি সমস্যার সমাধান মিলবে?
এই ফেব্রুয়ারির আগের ফেব্রুয়ারির উষার আঁধার ভেদ করে বিশাল জাম্বোটি সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে পা রেখেছে সবেমাত্র। আসা-যাওয়ার পথের ধারে বলে ব্যাংকক এয়ারপোর্টটিকে মনে হয় অনেক দিনের চেনা। পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে পেঁৗছলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। থাইল্যান্ডের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। শিখিনি, বড় বড় বিমানে প্রমোদভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য ছুটে যাওয়া সচিব, আমলা, রাজনীতিবিদ_কেউই কিছু শেখেননি। আসলে বছর বছর নাম পরিবর্তন বা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ত্রুটি সরিয়ে ঢাকাকে অনায়াসে একটি চালু রুটে পরিণত করা যেত, এখনো তা সম্ভব। এককালের বনেদি প্রাচীন ও অভিজাত কলকাতা বিমানবন্দরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই এ কথার সত্যতা চোখে পড়বে। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে সুভাষ বসু বিমানবন্দরে রাত নিশীথে বেশ কয়েকবার বিমান ধরতে বা উড়াল দিতে হয়েছে। যত্ন করে দেয়ালে উৎকীর্ণ নেতাজীর বাণী 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব'র এমন নির্মমতা দুঃস্বপ্নের মতো। শরীরের রক্ত জ্যাকেট, জামা, পাতলুন আর মোজা ভেদ করে মশায় নিয়ে যেতে দেখিনি কোথাও। সঙ্গে নেপথলিন আর ফিনাইলের কড়া গন্ধ। সে কড়া ঝাঁজও মূত্র প্রবাহের দুর্গন্ধ দূর করতে পারে না। সেদিক থেকে ঢাকা অনেক কেতাদুরস্ত। কিন্তু ঢাকার সমস্যা অন্যত্র। জটিলতা, সময়ক্ষেপণ, মালপত্রের দিকে ছোঁক ছোঁক দৃষ্টি আর দুর্ব্যবহার। এগুলো সামাল দিয়ে ঢাকাকে আধুনিক করে তোলার দায় যাঁদের, তাঁরা সেদিকে নজর দেওয়ার সময় পান না। তাঁরা তো ভিআইপি, তাঁদের চেকিং নেই, মালপত্রের ওজন নিয়ে ঝামেলা নেই, নেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানোর সময়। ফলে সুবিধা বা সুযোগ থাকার পরও ঢাকা গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কানেকটিং বা সংযোগ ফ্লাইটটির সময়সীমা বেশি না হলে থাই এয়ারপোর্টে টেনশনে থাকাটাই স্বাভাবিক। সে যাত্রায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষমাণ আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছিলেন এক আফ্রিকান যাত্রী। মনোরম পাসপোর্ট, অতি আধুনিক ছাড়পত্র, ভিসা থাকার পরও কাউন্টারের তরুণী তাঁকে ছাড় দিচ্ছিলেন না। তাঁর এক কথা, 'সিকিউরিটি প্রবলেম'। সে যাত্রায় হেনস্তা হওয়া আফ্রিকান যাত্রীটির একমাত্র অপরাধ বহনকৃত নিজ দেশের পাসপোর্টটি। নব্বইয়ের মধ্যভাগে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে একই অসুবিধায় পড়েছিলাম। উদ্দেশ্য দীর্ঘ যাত্রা বিরতিতে সিঙ্গাপুর শহর পরিভ্রমণ। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ডলার, সবুজ পাসপোর্টে অস্ট্রেলিয়ান স্থায়ী ভিসার ছাপ থাকার পরও ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন আর সন্দেহজনক চাউনি। শেষতক সিডনিগামী বিমানে চড়ার আগ পর্যন্ত এয়ারপোর্টের বাইরে পা রাখিনি। সেই একই যাত্রী, একই মানুষ আমরা কয়েক বছর পর সিডনি থেকে দেশে বেড়াতে যাচ্ছি। কয়েক দিন যাত্রা বিরতির পর ঢাকাগামী বিমানে চড়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি। কাউন্টারে পেঁৗছানোর পর শুরু হয়ে গেল প্রশ্নবাণ। একপর্যায়ে মালামাল নিয়ে বাদানুবাদ। নাছোড়বান্দা আমাদের তর্কের একপর্যায়ে পাসপোর্ট দেখানোর প্রয়োজন পড়ল। তাতেই কেল্লাফতে। ক্যাঙ্গারু মার্কা নীল পাসপোর্ট দেখার পরই তরুণী গুটিয়ে গেল। শামুকের মতো খোলসের ভেতর ঢুকে পড়ল যেন। ঘুরে-ফিরে এক কথা 'আগে বললেই হতো'। আমি বলি 'কী বললে হতো'? তাঁর উত্তর 'তোমরা অস্ট্রেলিয়ান, তোমাদের পাসপোর্ট অস্ট্রেলিয়ার।' আমার প্রশ্ন ছিল, 'তাতে কি মালামালের ওজন কমেছে, নাকি নিরাপত্তার কথিত ঝুঁকি নেমে গেছে পারদের মতো।' স্মিতহাস্যে তরুণী তখন ট্যাগ লাগিয়ে বোর্ডিং কার্ড গোছাতে ব্যস্ত। একেই বলে ইমেজ। সত্তরটিরও অধিক দেশে ভিসাহীন ভ্রমণের অধিকার দেওয়া আছে ক্যাঙ্গারু পাসপোর্টে। কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, ইউরোপ অথবা আমেরিকা এয়ারপোর্টে অবতরণ করলেই ভিসা অথবা বিনা ভিসায় বেশ কিছুদিন ভ্রমণের ফ্রি অভিজ্ঞতা। এর মূল রহস্য বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। কেউ যখন নিশ্চিত যে আপনি তাঁর দেশে পালিয়ে থাকবেন না বা আপনার ডলার তেজি ও সচল; যে আপনাকে বেগবান করবে বটে, বেগ দেবে না। সবুজ পাসপোর্টটি চেতনা ও বুকের রক্তে অর্জিত হলেও মর্যাদা বা ইজ্জতের লড়াইয়ে এ জায়গাটুকু অর্জন করতে পারেনি। আমাদের গর্ব বা আত্মমর্যাদা সীমানা অথবা গণ্ডি এড়াতে পারেনি। প্রতিটি দেশের পাসপোর্টে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের অনুরোধ থাকে। নিজ নিজ দেশের নাগরিককে যথাযোগ্য সুবিধা ও সহায়তা প্রদানের জন্য জানানো হয় বিনীত অনুরোধ। আমাদের বাড়ির দুই যুবক গিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকা আর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে। দুজনের ছিল দুই দেশের পাসপোর্ট। বাংলাদেশি পাসপোর্টের যুবকটি অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টধারীর তুলনায় শিক্ষা ও পেশায় অনেক এগিয়ে। তফাৎ এই, এখনো তাঁর নাগরিকত্ব হয়নি। এর পরও উভয়ের অভিজ্ঞতা একেবারে ভিন্ন ধরনের। প্রকৌশলী বন্ধুটির জন্য প্রায় বেকার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্টধারীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোনো কোনো দেশে তাঁকে নির্জন কক্ষে নিয়ে তল্লাশি করার পাশাপাশি একগাদা ফর্ম পূরণেও বাধ্য করা হয়েছিল।
এই যাতনা বা দুর্ভোগের কারণ সবুজ পাসপোর্ট। নিরীহ পাসপোর্টটির কী দোষ? ত্রুটি আমাদের রাজনীতিতে, দেশ শাসনে, ইমেজে আর আন্তর্জাতিক অবস্থানে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন এই সবুজ পাসপোর্টের হুবহু কপি আর ভোটার আইডির অভিজ্ঞতা ক্রয় করতে চাইছে কোনো কোনো দেশ। যাদের অবস্থান আমাদের চেয়েও পশ্চাতে। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী দেশ ফিজি। দ্বীপরাষ্ট্র ফিজিতে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ছড়াছড়ি। ইতিহাস বলে ইক্ষু চাষ ও কৃষির উন্নতিকল্পে নিয়ে আসা ভারতীয়রা আজ সেখানে প্রায় সমানে সমান। এতটাই যে এদের অগ্রজ মহেন্দ্র চৌধুরী সে দেশের শীর্ষ ক্ষমতায়ও চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আদিবাসী ফিজিয়ানরা তা মানেনি। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে সে সরকারের পতন ঘটিয়ে নৌপ্রধান এখন ক্ষমতায়। গণতন্ত্র হত্যার অপরাধে তিনি ও তাঁর দেশ প্রায় একঘরে। গণতন্ত্রে ফিরতে না পারলে বিশ্ব সাহায্য ও প্রতিবেশীদের সহায়তা বঞ্চিত হয়ে বাঁচা প্রায় অসম্ভব। তাই সে দেশে গণভোট জাতীয় প্রক্রিয়া চালু হতে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় ভোটার আইডি কার্ড নির্মাণে বাংলাদেশের সহায়তা চেয়েছে ফিজি। বিনিময়ে মূল্য তো বটেই, আমাদের দেশের শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার বিষয়টিও তুলেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।
যদি সেটা হয়, আমরা আমাদের একটি অর্জনকে অন্তত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে পারব। এরপর আসবে পাসপোর্টের কথা। অর্থাৎ লাল-সবুজ চাইলে এগোতে পারে। এর সম্ভাবনা চাক্ষুষ। কিন্তু ভাবমূর্তির ব্যাপারে, নিজেদের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে গণতন্ত্রী ও আধুনিক হওয়ার বিকল্প নেই। রাজনীতি যদি এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ও দূরদর্শী হতে পারে, ধীরে ধীরে সবুজের প্রতি মমত্ব বাড়বে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা দুঃশাসনের মতো বিষয়গুলো ফিকে হয়ে আধুনিকতাকে বড় করে তুলতে পারাটাই হচ্ছে উত্তর। না হলে দেশপ্রেমের বায়বীয় ধারণায় কাজ হবে না। সত্যিকার দেশপ্রেম ও গঠনমূলক শাসনেই আমাদের জয়, আমাদের এগিয়ে যাওয়া। চলি্লশ বছরে এটা নিশ্চয়ই বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না।
লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.