চরাচর-বাংলার নকশিকাঁথা by ফখরে আলম

নকশিকাঁথা, সেলাই-ফোঁড়াই, সূচিশিল্প_সবই লোকশিল্প। এর সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, পারিবারিক ঐতিহ্য, আত্মীয়তার বন্ধন যুক্ত হয়ে আছে। ইতিহাসের সেই নকশিকাঁথায় কোনো বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। নকশিকাঁথা মূলত যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও রাজশাহী অঞ্চলে তৈরি হয়।


এর মধ্যে যশোরের নাম সবার আগে রয়েছে। যশোরের নকশিকাঁথা সূচিশিল্পের শত শত বছরের আলোকময় ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাস সন্ধানে দেখা যায়, পাঁচ-সাত শ বছর আগে থেকেই এই জনপদের মানুষ শীত নিবারণের জন্য নকশিকাঁথা গায়ে জড়িয়ে ওম নিয়েছে। পুরনো ব্যবহৃত শাড়ির পাড়ের সুতো তুলে নানি-দাদিরা বছরের পর বছর ধরে নকশিকাঁথা সেলাই করেছেন।
একসময় তুলা থেকে সুতা তৈরি করে সেই সুতা দিয়ে গৃহবধূরা নকশিকাঁথায় তাঁদের শিল্পনৈপুণ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র মিত্র 'যশোর খুলনার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, পাঠান আমলেই যশোর বস্ত্রশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। উৎকৃষ্ট তুলা উৎপাদনের কারণে এই সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়। এই ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে আজ থেকে সাত শতাধিক বছর আগে এই জনপদের বস্ত্র একটি পৃথক স্থান দখল করে ছিল। সতীশচন্দ্র মিত্র আরো লিখেছেন, 'স্ত্রী লোকেরা কাঁথা সেলাই ও শিকা প্রস্তুত করিয়া অন্য দেশকে পরাজয়-করত যশোলাভ করিতেন।' তাঁর এই লেখায় প্রমাণিত হয়, শত শত বছর আগেও যশোর এলাকার মহিলাদের হাতে তৈরি নকশিকাঁথা দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিল, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
১৯৭১ সালের পর সেলাইকাজের প্রসার বৃদ্ধি পায়। আশির দশকে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান ঋণ কর্মসূচির পাশাপাশি গ্রামের মহিলাদের নকশিকাঁথাসহ অন্যান্য সেলাইকাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। নব্বইয়ের দশকে যশোরের শিক্ষিত বেকার তরুণ-যুবকরা নকশিকাঁথা সেলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়।
স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ওই তরুণ-যুবকরা গ্রামের মহিলাদের দিয়ে নকশিকাঁথা, পাঞ্জাবি, থ্রিপিস, ফতুয়া ও শাড়ি তৈরি করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত শুরু করে। বর্তমানে যশোর অঞ্চলের পাঁচ লাখ মহিলা সূচিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। যশোরের নকশিকাঁথা এখন দেশ জয় করে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ অঞ্চলের সূচিশিল্পের উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য ফোঁড় ক্রাফটস নামের একটি সংগঠন সূচিশিল্পীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
খ্যাতিমান ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল ইতিমধ্যে কয়েকজন সূচিশিল্পীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বাঙালির নিজস্ব শিল্প আমাদের লোকশিল্প নকশিকাঁথা সূচিশিল্প। এই শিল্পে বাংলাদেশের আবহমানকালের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ শিল্পের বিকাশে আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে কিছু এনজিওর ক্ষেত্রে অভিযোগ, তারা নকশিকাঁথা নিয়ে বাণিজ্য করেছে। কাঁথাশিল্পীদের পারিশ্রমিকের দিকে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সূচিশিল্পীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ফখরে আলম

No comments

Powered by Blogger.