গন্তব্য ঢাকা-ঢাকা তাঁকে টানে না by সিদরাতুল সিনড্রেলা

পূর্ব দিকে মেঘনা নদী, পশ্চিমে মেঘনারই শাখা কালী নদী, মাঝে মাটির ঘর, যা এলাকায় উন্নত ধরনের ঘর হিসেবেই পরিচিত। সেই ঘরেই বাস করেন শামসুল হকের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও মা। গ্রামের সেই মাটির ঘরে অফুরন্ত ভালোবাসার মধ্যে যে সুখ রয়েছে, সেই সুখ ঢাকার এই ইট-পাথরের বাড়িতে উঁচু পালঙ্কে ঘুমিয়ে দুবেলা মাছ-মাংস খেলেও কি


মিলবে? কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার রসুলপুরের বাসিন্দা মো. শামসুল হকের এমনই মনে হয় প্রতিনিয়ত। মেয়ের হঠাত্ আবদার, ছোট ছেলের আধো আধো বোল, কখনো স্ত্রীর কপট অভিমান বা বৃদ্ধা মায়ের নজরদারি এই শহরে কোথায় মিলবে?
কাঁঠালবাগান বাজার ডানে রেখে একটু এগোলেই চোখে পড়বে এক হোটেল; যার নাম লাকি হোটেল। এই হোটেলের ডান পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি গলি। এই গলি ধরে একটু সামনে এগোলেই একটি বাড়ির সামনে দেখা মিলবে তাঁর। এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন ৪৬ বছর বয়সী লোক। বুট, ছোলা, বাদাম, শিমের বিচি নিয়েই তাঁর ব্যবসা। মো. শামসুল হক এখানে দাঁড়িয়েই রোজ সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কেনাবেচা করেন।
গাঁ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়, বিস্তীর্ণ মাঠ, মা-বাবা, ভাইদের নিয়ে আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল শামসুল হকের জীবন। ভাইদের মধ্যে তিনি পাঁচ নম্বর। তাঁর দাদার যে পরিমাণ সম্পত্তি ছিল তার চাল, ডাল, সবজি সারা বছর খেয়েও ফুরাত না। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা চলত রাজার হালে। কিন্তু পরে এসব সম্পত্তি ভাগ হয় বাবা-চাচাদের মধ্যে, এরও পরে ভাগ হয় ভাইদের মধ্যে। ফলে স্বভাবতই পরিমাণ আসে কমে। তারপর যে কিসের নেশায় ধরল, পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন দশম শ্রেণীতে মাধ্যমিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে। নিজে কিছু করার আশায় ১৯৮২ সালে চলে এলেন ঢাকায়। ২৫ বছর বয়সে বিয়ে করলেন গ্রামেরই এক মেয়েকে। কোলজুড়ে এল দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন। জামাই পড়াশোনা করে ঢাকায়। ছোট মেয়েটি পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে। তার পরের ছেলেটি পড়ে মাদ্রাসায়।
‘আপনি কি কখনো গোল্লাছুট খেলেছেন?’
‘আরে কী কয়? দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, হা-ডু-ডু, ফুটবল খ্যালতে খ্যালতেই তো দিন কাটাইচি। কত্ত যে মজা করসি। তয় ব্যাট-বল খেলি নাই কহনো।’ কথাগুলো বলতে বলতে উজ্জ্বল মুখটি যেন আরও বেশি আলোকিত হয়ে ওঠে শামসুল হকের।
তাঁর গ্রামের অনেক মানুষই বিদেশে। কেউ দুবাইয়ে, কেউ সৌদি আরবে আবার কেউ বা মালয়েশিয়ায়। গ্রামে যারা এখনো আছে, তাদের প্রায় সবাই কৃষিকাজ করে। ‘চাইলে আমিও যাইতে পারতাম বিদেশে। আমাগো অনেক পরিচিত লোকজন আছে দুবাই, সৌদি আরবে। তয় যাই নাই।’ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
‘আমিও কত খ্যাতে (খেতে) কাম করসি। হেন কাজ নাই আমি করি নাই। নাটকও করসি ১০টার মতো। জোকারের অভিনয় করতাম। মানুষকে হাসাইতে খুব ভালো লাগে। তহন বন্ধুগো লগে সারা দিন ঘুরসি, হাসাহাসি করসি, খেলাধুলা করসি। অহন তো হ্যারা একেকজন একেক জায়গায় আছে। তয় গ্রামে গেলে দেখা হয় তাগো লগে।’ কথাগুলো বলতে বলতে তিনি যেন অতীতেই ফিরে যাচ্ছিলেন।
দীর্ঘ এক মাস বা ২০ দিন পর পর গ্রামে যাওয়ার সুযোগ মেলে তাঁর। যখন গ্রামে যান তখন স্ত্রী, সন্তান আর মায়ের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকেন। শ্বশুরবাড়িতেও যান মাঝেমধ্যে। তখন তো আদর-আপ্যায়নের শেষ থাকে না।
ছোট মেয়েটি বড় হচ্ছে। তাকেও তো বিয়ে দিতে হবে। সে জন্য টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা জোগাড় করে মেয়ের বিয়ে দিয়েই গ্রামে চলে যাবেন শামসুল হক। এখন তো গ্রামে করার মতো কিছু নেই, তাই ঢাকাতেই থাকতে হয় পরিবারবিহীন একা একা। একটি ঘরে আটজন একসঙ্গে থেকে বুয়ার রান্না করা খাবার খেয়েও প্রতিদিন শামসুল হক অনুভব করেন বাড়িতে ফেরার তাগিদ। স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে থাকেন ভবিষ্যতের দিকে, কখন কয়েকটি বছর কাটবে, টাকা জোগাড় করবেন, মেয়ের বিয়ে দেবেন, তারপর ফিরে যাবেন নিজের নীড়ে। গ্রামের সুস্থ, সুন্দর, সচ্ছল পরিবেশ ছেড়ে ঢাকার এই অসুস্থ ও দরিদ্র পরিবেশ কিছুতেই তাঁকে টানে না।

No comments

Powered by Blogger.