মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র-ভালোবাসা ও ভয় সৃষ্টির বাসনা by বার্ট ফিস্ক

জর্ডানের রাজধানী আম্মানের বহির্ভাগে পার্বত্য এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল দূতাবাস। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনীর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তেমনই বিশেষ এক অফিস চালান। তিনি জর্ডানের সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে তথ্য কেনেন। আফগান, ইরাকি পুলিশ ও সেনাদের প্রশিক্ষণদানেও তিনি সহায়তা করেন।


শুধু আল-কায়েদা বিষয়েই নয়, জর্ডানের নাগরিকদের বিষয়ে, বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহর প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য এবং জর্ডানে বসবাসকারী যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী—প্রধানত ইরাকি কিন্তু আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইরাকি আল-কায়েদা বিদ্রোহীদের সম্পর্কে তিনি তথ্য চান।
মধ্যপ্রাচ্যে সেনা কর্মকর্তাদের কেনা সহজ। ২০০১ ও ২০০২ সালের অনেকটা সময় যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজদের কিনতে খরচ করে। ইরাকে তাদের দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জর্ডানের সেনাদের যোগ দেওয়ার জন্য তাদের অর্থ দেওয়া হয়। ফলে বাগদাদে অবস্থিত জর্ডান দূতাবাসে প্রচণ্ড বোমা হামলা চালায় ওয়াশিংটনের শত্রুরা।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) ‘ডাবল এজেন্ট’ হুমাম খলিল আবু-মুলাল আল-বালাবির কাজটি গতানুগতিক। আল-কায়েদার অনেক অনুসারীর মতো তিনিও পেশায় চিকিত্সক। দুই পক্ষের জন্যই তিনি কাজ করেছেন। কারণ, আরব গোয়েন্দা বাহিনীগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিত্রদের’ ভেতর বহু আগেই ঢুকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুরা। এমনকি ইরাকে কার্যকরভাবে আল-কায়েদার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া আবু মুসাব আল-জারকাবি জর্ডানের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। জারকাবি নিজেও ছিলেন জর্ডানের অধিবাসী। গোয়েন্দা সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শরিফ আলী বিন জেয়িদ যুক্তরাষ্ট্রের সাত সদস্যের সঙ্গে চলতি সপ্তাহে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৩ সালে বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে বোমা হামলার ঘটনার পর এটি সিআইএর জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের গুপ্তচরবৃত্তি রোমাঞ্চকর কোনো বিষয় নয়। আফগানিস্তানে মারা যাওয়া সিআইএর লোকদের কয়েকজন আসলে ভাড়াটে ছিলেন। জর্ডানের ‘মুখাব্বারাত’ গোয়েন্দারা যাদের শত্রু মনে করত, তাদের ওপর নিত্যনৈমিত্তিক নির্যাতনের কৌশল প্রয়োগ করে। বিন জেয়িদ ও আল-বালাবি উভয়ই জর্ডানের মুখাব্বারাতের হয়ে কাজ করেছেন। যাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো নৈমিত্তিকভাবে। বুশ প্রশাসনের সময়ের সিআইএ আম্মানের কাছে তাদের সম্পর্কে অবহিত করত।
জর্ডানের কোনো গুপ্তচর আফগানিস্তানে কেমন করে কাজে আসতে পারে, তা যতটা রহস্যের, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাযন্ত্রে ‘ডাবল এজেন্ট’দের উপস্থিতি ততটা নয়। পশতু বা দারি বা উর্দু ভাষায় কথা বলে এমন আরবের সংখ্যা অল্প, যদিও আফগানদের আরবি বলতে পারার হার অপেক্ষাকৃত বেশি। এ থেকে ধারণা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আম্মানভিত্তিক ইরাকি বিদ্রোহী ও আফগানিস্তানভিত্তিক বিদ্রোহীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র ছিল।
এখন স্পষ্ট যে, ইরাক ও আফগানিস্তানের মধ্যে ইরানের বিশাল এলাকা থাকা সত্ত্বেও ইরাকি ও আফগান আল-কায়েদা কর্মীরা একে অন্যকে সহযোগিতা করছিল। এত দিন তাদের কাজের স্থানান্তরকে মনে করা হতো পুরোপুরিভাবে অনুপ্রেরণার উদ্দেশ্যে। অন্যভাবে বলা যায়, যেমন করে সিআইএ খুশিমনে ধরে নিয়েছিল, সংস্থাটি মুসলিম বিশ্বে স্থানীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে, বিদ্রোহীদেরও তেমনি করতে সক্ষম। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী জর্ডানি গুপ্তচরের উপস্থিতি, যে নিজের দেশ ছেড়ে এত দূর এসে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারে, প্রমাণ করে আম্মান ও পূর্ব আফগানিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রবিরোধীদের মধ্যে যোগসূত্র কতটা কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী জর্ডানিদের ইসলামাবাদ অবধি যোগসূত্র আছে, এ কথা খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না।
এই কথা যদি কষ্টকল্পিত বলে মনে হয়, তাহলে আমাদের স্মরণ করা উচিত, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে আরব যোদ্ধাদের সিআইএ প্রথম সহযোগিতা দেওয়া শুরু করলে তাদের অর্থ দিয়ে সহায়তা করে সৌদি আরব। গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে সৌদি আরবের নিজস্ব গোয়েন্দা অধিনায়ক ইসলামাবাদের সৌদি দূতাবাসে নিয়মিত ওসামা বিন লাদেন এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসতেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনী তখন ‘মুজাহিদিন’দের সাজসরঞ্জাম সংগ্রহে সহায়তা করত। পরে তারা তালেবানকে এমন সহায়তা দেয়, এখনো যা অব্যাহত আছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে, আফগানিস্তানে তার শত্রুদের অথবা ইরাক ও জর্ডানে একই রকম মৌলবাদী শত্রুদের সৌদি আরব আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে না, তবে মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে সিআইএর বিশেষ ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে হয়তো তা-ই হয়েছে। একই সঙ্গে ভালোবাসা ও ভয় উত্পাদন করার যুক্তরাষ্ট্রের বাসনা দীর্ঘ সময় ধরে দেশটির গোয়েন্দা বাহিনীকে তাদের লোক দেখানো মিত্রদের বিশ্বাস করতে এবং তাদের অনুমিত শত্রুদের পাশবিক হিসেবে গণ্য করার ভুল পথে চালিত করেছে। ১৯৮৩ সালে এক শিয়া আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস উড়িয়ে দেওয়ার আগে ঠিক এমনটিই ঘটেছিল। এমন সময়ে ঘটনাটি ঘটেছিল যখন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত সিআইএর প্রায় সব কর্মী দূতাবাসের ভেতরে বৈঠক করছিলেন। তাদের অধিকাংশই এতে মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্রমুখী দূতাবাসে অবস্থিত সিআইএ অফিসের প্রবেশপথে নিবিড় প্রহরা ছিল। কিন্তু লেবাননে তাদের স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে এমন কিছু নারী-পুরুষ ছিল, যারা ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর প্রথম দিককার সংস্করণ—উভয়ের সঙ্গেই কাজ করছিল। দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্মীরা কোনো নিরাপত্তা ছাড়পত্রহীন লেবাননের এক নারীর সঙ্গে দেখা করে।
কিন্তু জর্ডান-যুক্তরাষ্ট্র মেরু ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। এখানে সিআইএ প্রায় পুরোপুরি সুন্নি-মুসলমান পরিবেশে কাজ করছে। সিআইএর অর্থ গ্রহণের পাশাপাশি ওয়াশিংটন ও জর্ডানের বাদশাহর নীতির বিরোধিতা করার মতো বহু কারণ জর্ডানিদের আছে। জর্ডানের মুহাব্বারাতদের মধ্যে সংখ্যায় অনেকে উেসর দিক থেকে ফিলিস্তিনি। তারা বিশ্বাস করে, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনাহীন, তোষামোদমূলক সমর্থন তাদের ফিলিস্তিন জাতিকে ধ্বংস করেছে এবং জনগণকে ধ্বংস করছে। ‘ভাড়ায় খাটা স্থানীয়’দের বিশ্বাসে সিআইএর বাসনা অনেকটা ব্রিটিশদের বিদ্রোহের আগে আগে ভারতীয় সিপাহিদের ওপর আস্থা রাখার মতো। ব্রিটিশরা আশা করেছিল, তাদের স্থানীয় রেজিমেন্টগুলো কখনো ব্রিটিশরাজের বিরোধিতা করবে না, তাদের ভারতীয় কর্মকর্তারা বিশ্বস্ত থাকবে। কিন্তু তারা বিশ্বস্ত থাকেনি।
দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.