স্মরণ-সমর দাশ : পূর্ব দিগন্তে সূর্য তুলেছিলেন by সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

স্বাধীনতার পরের বছর বিবিসি লন্ডন থেকে জাতীয় সংগীত হিসেবে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'র মূল গানটি প্রচারের জন্য ওয়েস্টার্ন নোটের প্রয়োজন হলে দেখা গেল তা তৈরি নেই। অন্য দেশের সুরকার তৈরি করলে এর ব্যাকরণ পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে।


তাই সামরিক ব্রাসব্যান্ডে রেকর্ড করে বাজানোর জন্য 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'র ওয়েস্টার্ন নোট নিখুঁতভাবে তৈরি করেছিলেন সমর দাশ। আজও সেই অনুকরণে প্রতিদিন গাওয়া হয় আমাদের জাতীয় সংগীত। পুরান ঢাকার গলিতে মাঝরাতে এক বাউণ্ডুলের বাঁশির সুর দীর্ঘ সময় ধরে বাজত তাঁর মনের ভেতর। কান পেতে শুনতেন বৃষ্টির শব্দ। প্রতিমুহূর্তে জীবনের এসব টুকরো টুকরো ভালো লাগা সমৃদ্ধ করেছে চেতনা; আর রক্তের ভেতর সুর, সে তো পরিবারের কাছ থেকে জন্মগত অর্জন। তাই মুক্তির জন্য গোটা দেশ যখন তোলপাড়, সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে তাঁরই সুরে সুরে বেজে উঠেছিল 'রক্ত লাল রক্ত লাল', 'সময় যে হলো হলো নোঙর তোলো তোলো'র মতো সব জাগরণী সংগীত। সেদিন তিনি শুধু সুর করেননি, এক সুরে যেন বেঁধেছিলেন মুক্তিপাগল মানুষকে। সেই সুর যেদিন বাংলার প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন শুধু মুক্তিযোদ্ধারা নন, একেবারে অবুঝ মানুষটিও ডাক শুনেছিল স্বাধীনতার, স্বপ্ন দেখেছে পরাধীনতামুক্ত দেশের। ৪০ বছর পর আজও বিজয়-আনন্দ অসম্পূর্ণ হবে প্রথম প্রহরে শহীদ বেদিতে, স্মৃতিসৌধে সমর দাশের সুর করা গান বেজে না উঠলে। শুধু সুরকার নন, সুর-যোদ্ধাও বটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রধান পরিচালক ছিলেন তিনি। সমর দাশ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাঁশিওয়ালা' কবিতার কয়েকটি লাইন 'বাঁশিওয়ালা, বেজে ওঠে তোমার বাঁশি, ডাক পড়ে অমর্ত্যলোকে, সেখানে আপন গরিমায় উপরে উঠছে আমার মাথা।' তাঁর শুরুটাও বাঁশি দিয়েই। মাত্র ১৬ বছর বয়সে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে বাঁশি বাজিয়ে সংগীতজীবনের সূচনা। এককথায় অসাধারণ বাজাতেন। শুধু বাঁশি নয়, সেই সঙ্গে গিটার এবং পিয়ানোও। জন্ম ১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর। পুরান ঢাকার নবদ্বীপ বসাক লেনে একটি খ্রিস্টান পরিবারে। মেধা আর সাধনার সঙ্গে আবেগের সমন্বয় করে যেন নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন সমর দাশ। ছিল পরিশীলিত মনোভাব। কেননা পরিমিতি বোধ খুব বেশি প্রয়োজন সংগীতের ব্যাকরণে। ১৯৫০ সালে কলকাতার 'লটারি' ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন। প্রথম বাংলা ছবি 'মুখ ও মুখোশ'-এর সংগীত পরিচালকও তিনি। এর চার বছর পর অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান মিউজিক কনফারেন্সের পরিচালক ছিলেন সমর দাশ। ১৯৬১ সালে ঢাকা বেতারকেন্দ্রে যোগ দেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। বাংলাদেশ সংগীত পরিষদের অন্যতম এই সদস্য তাঁর ব্যক্তিগত ভালো লাগাকে পেঁৗছে দিয়েছিলেন দেশের প্রতি ভালোবাসার কাছে। ১৯৮৫ ও ১৯৯৫ সালে সাফ গেমসের সূচনা ও সমাপনী সংগীতে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন মানুষ শুনেছিল নতুন জন্ম নেওয়া একটি দেশের সুরকারের তৈরি সুর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গোল্ড মেডেল পুরস্কার, স্বাধীনতা ও একুশে পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা রয়েছে তাঁর। তবে কোনো সম্মাননা নয়, অনেক ঊধর্ে্ব সমর দাশের অবদান। একটি দেশ তাঁর সংগীত-সংস্কৃতির জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ সমর দাশের কাছে। মৃত্যুদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম

No comments

Powered by Blogger.