ভারত-পাকিস্তান-শান্তি স্থাপনই শেষ কথা নয় by গওসল আযম

পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি স্থাপিত হলেও সবকিছুর সমাধান হবে না। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সহসাই কোনো উন্নতি হবে না। তবে বাড়তে পারে সেনাদের ওপর রাজনীতিবিদদের প্রভাব। সরকার পর্যায়ক্রমে হতে পারে সেনা প্রভাবমুক্ত।


বাড়তে পারে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য
খাতের ব্যয়



ধর্মোৎসারিত আবেগকে পুঁজি করে ভারতীয় উপমহাদেশের ন্যক্কারজনক বিভক্তি ঘটে আগস্ট মাসের ১৯৪৭ সালে। বিভক্তির পর ভারত স্বল্পতম সময়ে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের মধ্যে দেশ পরিচালনার রক্ষাকবচ গ্রহণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়। পাকিস্তান শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হয়। পরিচালিত হতে থাকে আমলা এবং সেনাদের ইচ্ছানুসারে যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেআইনি বা সাদামাটাভাবে বলতে গেলে জংলি। এরপরও কিছু সংখ্যক বিবেকবান মানুষ আমলা ও সেনাদের থাবা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে ১৯৫৬ সালে গঠনতন্ত্র গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান অক্টোবর ১৯৫৮ সালে জনগণের এগিয়ে যাওয়ার ম্যান্ডেট বা শাসনতন্ত্র পদদলিত করে সামরিক ফরমানবলে দেশ পরিচালনা শুরু করেন। দেশের সার্বিক মঙ্গলচিন্তা না করে ভারতবিরোধী মনোভাবের গোড়ায় জল ঢালেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করার কাজ অব্যাহত রাখেন কাশ্মীর দখল এবং দেশ রক্ষার নামে। সেনাদের ওপর ন্যস্ত হয় অত্যধিক ক্ষমতা। তারা আরও স্বেচ্ছাচারী হয়। গণমানুষ বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের চাপে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ১৯৬২ সালে জোড়াতালি দেওয়া গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হয়। অপশাসনের জ্বালায় পিষ্ট হয়ে পূর্ব পাকিস্তান রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় ১৯৭১ সালে। পাকিস্তানি সেনারা আরও ভারতবিদ্বেষী হয়। চলতে থাকে সামরিক শক্তি অধিকতর শক্তিশালী করার। পাকিস্তানের সেনাসংখ্যা ৫ লাখ ৫০ হাজার যা ভারতীয় সেনাসংখ্যা ১১ লাখের বিপরীতে অনেক কম। পাকিস্তানি বাজেট ব্যয়ের ১৬ শতাংশ যায় সেনা খাতে আর শিক্ষা খাতে যায় মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ। সেনারা ঘন ঘন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে গণতন্ত্রকে তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলতে দেয়নি।
পাকিস্তানি সেনারাই পাঞ্জাবনির্ভর ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বা (ওঊঞ) তৈরি করেছে ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্যে। ডিসেম্বর, ২০০১ সালে লস্কর-ই-তৈয়বা কর্তৃক ভারতীয় আইনসভা আক্রান্ত হওয়ার পর পাকিস্তান তা নিষিদ্ধ করে। ধারণা এই যেম তা এখনও সেনাদের পক্ষপুটে আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব ক্ষুণ্ন করার জন্য। লস্কর-ই-তৈয়বা সেনাদের পক্ষপুটে থাকুক বা না থাকুক এর বিনাশ অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন। এর এখন অনেক শাখা-প্রশাখা। সেগুলো ভারত এবং পাকিস্তান আক্রমণ করে এবং বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানে জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের সমাধানে শুধু ভারতই নয় পশ্চিমা বিশ্বও উপকৃত হবে। ভারত এবং পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে রক্তপাত হয়েছে ধর্মীয় ঐতিহাসিক এবং ভূখণ্ডগত কারণে। কাশ্মীর এখন শান্ত হলেও, চরম উত্তেজনা বিরাজমান। ভারত কাশ্মীর বিষয়ক অনেক প্রকাশনা এখন জব্দ করে। ভারত এবং পাকিস্তানের দূরদর্শী রাজনীতিবিদরা সমঝোতা প্রত্যাশী হলেও করতে পারে না। ভারতের না পারার কারণ উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং পাকিস্তানের উগ্র মুসলমান জঙ্গিবাদ এবং সেনা প্রভাব। ভারতীয় উপমহাদেশের শঙ্কিতরা মনে করে, উভয় দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ হবে না এই কারণে যে, আক্রমণকারীকে প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে প্রতিআক্রমণে। এখন আর এই ধারণা হালে পানি পায় না এই কারণে যে, ২০০৮ সালে আমেরিকা ভারতের সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে বেসামরিক কাজে পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করে। অন্যদিকে পাকিস্তানও তাদের পারমাণবিক অস্ত্র সংরক্ষণাগারের প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এপ্রিল ২০১১ সালে পাকিস্তান ঘোষণা করেছে যে তারা একটি ক্ষুদ্রাকৃতির পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত ভ্রাম্যমাণ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। ১৩ মে, ২০১১-এ পাকিস্তানের আইএসআই প্রধান আইনসভাকে এই মর্মে অবহিত করেছেন যে, তিনি আক্রমণের জন্য ভারতীয় লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় করে আক্রমণের মহড়া দিয়েছেন। এ আক্রমণ পারমাণবিক আক্রমণ কি-না সুস্পষ্ট করে না বললেও তার সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায় না। পশ্চিমা পত্রপত্রিকার মতে, পাকিস্তানের এখন বিপজ্জনক সময়। এর সংগ্রামশীল যোদ্ধারা প্রমাণস্বরূপ দেখাতে চায় বিন লাদেনের পরও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। তাদের সুযোগ আছে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর ইন্ধন দেওয়ার অথবা পারমাণবিক বিস্টেম্ফারণ ঘটানোর।
সেনাদের ভারতবিরোধী মনোভাব সত্ত্বেও রাজনীতিবিদরা দীর্ঘ ২০০৪-০৭ পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তারা ভারতীয় কাশ্মীরের ওপর তাদের দাবি ত্যাগ করবে। বিনিময়ে ভারত সীমান্ত যাতায়াত সহজ করবে। এই সমঝোতাকে নস্যাৎ করার জন্য লস্কর-ই-তৈয়বা ২০০৮ সালে অতর্কিতে মুম্বাই আক্রমণ পরিচালনা করে এবং ১৭০ জন প্রাণ হারায়। এরপরও ভারত পাকিস্তানের উভয় সরকার আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং আলোচনা চলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ক্রিকেট উপলক্ষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ বছরের জুলাই মাসে আলোচনার জন্য নির্ধারণ করেছেন। ভারতের মাটিতে অতর্কিতে আক্রমণ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের ওপর প্রবল চাপ। ১৩ জুলাই, ২০১১-এ মুম্বাইয়ে আবারও একই সময় পরপর ৩টি বিস্টেম্ফারণ ঘটানো হয়। মারা পড়ে ২১ এবং আহত হয় ১৫০ জন। আহতদের অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঘটনার জন্য ভারতের মুজাহিদিন গ্রুপ ছাড়াও পাকিস্তানের লস্কর-ই তৈয়বার দিকে সন্দেহের তীর। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে অনুসন্ধান চলছে। বেসামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের যে চুক্তি, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যন্ত সংযমী হওয়ার চাপ প্রয়োগ করছে। চেষ্টা করছে কাশ্মীরের ব্যাপারে পাকিস্তানিকে নমনীয় করার। একই সঙ্গে অস্ত্র প্রদানের সুবাদে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ না করে আলাপ করছে সেনাদের সঙ্গে যাতে ভারতের ওপর আক্রমণ না হয় এবং শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের শান্তি স্থাপিত হলেও সবকিছুর সমাধান হবে না। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সহসাই কোনো উন্নতি হবে না। তবে বাড়তে পারে সেনাদের ওপর রাজনীতিবিদদের প্রভাব। সরকার পর্যায়ক্রমে হতে পারে সেনা প্রভাবমুক্ত। বাড়তে পারে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়। আফগানিস্তানের ব্যাপারে হতে পারে দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন।

গওসল আযম : প্রাক্তন মহাসচিব, আইবিবি ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.