কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু রঙ্গে ভরা। এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি যে এ কথা বারবার আজকাল মনে হয়। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনে কত রঙ্গই না দেখছি। কত রকম খেলা দেখে দেখে যে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। কত অসংগতি, কত অনৈতিকতার পাকে ঘুরপাক খেতে খেতে বিভ্রান্ত হয়ে ভাবি_এই কি চেয়েছিলাম! তবু


একেকটা ধাক্কা সামলে নিয়ে আবার নতুন আশায় দিনবদলের স্বপ্ন দেখি। তবে স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও বেশি সময় লাগে না। নতুন স্বপ্নের সোপানে পা রেখে কেন বারবার মনে হয়, আমরা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যতই এগোচ্ছি, ততই এক হিংস্রতা, অসহিষ্ণুতা আমাদের গ্রাস করছে। প্রযুক্তি আমাদের শ্রমভার লাঘব করেছে। আগে প্রচণ্ড গরমে মায়ের আদরমাখা হাতপাখার বাতাস খেতাম, এখন বৈদ্যুতিক পাখা সতত ঘূর্ণায়মান। কেউ কেউ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বা গাড়িতে বসে গরমকে কাছে ঘেঁষতে দেন না। তাঁদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে কি দেশটা বড়লোকদের দেশ হয়ে যাচ্ছে? মোটেও তা নয়। যে অসংগতি ও অনৈতিকতার কথা বলছিলাম, বড়লোকদের চরিত্রে তা মাখামাখি হয়ে আছে এবং সমাজে স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে সেসব সিদ্ধও। প্রযুক্তির উন্নতিতে কলম ধরে লেখার বদলে প্রথমে এসেছিল টাইপরাইটার এবং এখন ঘরে ঘরে কম্পিউটার-ল্যাপটপ। ডাকের চিঠিতে রিচার্ডসনের আমল থেকে পত্র-সাহিত্যের শুরু। আজ আর কেউ ডাকে চিঠি লেখে না। কাগজের মন দেওয়া-নেওয়ার বদলে এখন ই-মেইল, ফেইসবুক। ডাকঘর, ডাকপিয়ন এখন যেন দৃষ্টিতেও পড়ে না। আমি নিজেও তো ডাকঘরে শেষ কবে গেছি মনে করতে পারি না। তবে অতিথিদের বাড়ি চেনানোর জন্য বলি, আমি শান্তিনগর ডাকঘরের পাশের গলিতেই থাকি। প্রতিদিন এই একটি মাত্র কারণে_তবু ডাকঘরের নাম নেই। জীবন এখন অনেক আরামদায়ক। কষ্ট না করে কেষ্টর দেখা পেয়ে যাচ্ছি যে। আগে রেডিও শুনতাম_নাটক, অনুরোধের আসরে হেমন্ত-সন্ধ্যা-মান্না-শ্যামল-লতা-মানবেন্দ্রর আধুনিক গান। সে যেন কয়েক শতাব্দী আগের কথা। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল কুমারদের অভিনীত রেডিও নাটক শুনে যে শান্তি পেতাম, সে শান্তি মারা গেছে। এখন চিত্তবিনোদনের জন্য সর্বদাই মজুদ টেলিভিশন। সঙ্গে হাজারো চ্যানেল, হাতে রিমোট যন্ত্র। একটা ভালো না লাগলে আরেকটা দেখো। আজকাল সব কিছুই মাল্টিপারপাস। মালটিন্যাশনাল, মালটিচ্যানেল। আরো একটি বিষয় আছে। মাইক্রো, না ম্যাক্রো। ছোট করে দেখব, না বড় করে দেখব। এখন তো সব কিছুই ছোট। ছোট ঘড়ি, ছোট ফোন, ছোট টিভি। ক্ষুদ্রের মধ্যে মহাব্রহ্মাণ্ড পুরে ফেলেছি আমরা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে দেখে ফেলছি দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ফুটবল, শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা নৃত্য। কম্পিউটারে জ্ঞানের বিশ্বকে পুরে ফেলেছি। এ প্রসঙ্গে পৌরাণিক গল্পের কথা মনে হচ্ছে। দেবী-দুর্গা একবার তার দুই পুত্রকে পরীক্ষা করতে বললেন, তোমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করে এসে আমাকে প্রণাম করতে পারবে। এক পুত্র কার্তিক, তাঁর বাহন ময়ূর। কার্তিক মুহূর্তেই ময়ূরের পিঠে চড়ে দ্রুতগতিতে বিশ্ব প্রদক্ষিণে চলে গেল। আরেক পূত্র গণেশ, স্থূলদেহী এবং তার বাহন হচ্ছে ইঁদুর। কার্তিক ময়ূরে চড়ে উড়ে গেলে গণেশ তার মাতৃদেবীর চারপাশে তিনবার ঘুরে এসে প্রণাম জানিয়ে বলল, আমার বিশ্বপ্রদক্ষিণ হয়ে গেছে। এখন তো সেই গণেশেরই যুগ। কার্তিকের মতো ময়ূরের বদলে দুরন্ত গতির প্লেনে চড়ে এখন আর বিশ্ব প্রদক্ষিণ করার দরকার নেই। কম্পিউটারে তিনবার বোতাম টিপলেই বিশ্বভ্রমণ হয়ে যায়। সত্যিই ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী। বাংলাদেশ বিমানের একসময়কার বিজ্ঞাপনী স্লোগানটার কথা মনে পড়ল। হাতের মুঠোয় বিশ্বকে ধরে আমরা পেয়েছি অনেক কিছু। নিয়েছিও ঢের। স্বার্থপরতা, লোভ, অনৈতিকতা, হিংস্রতা, অসহিষ্ণুতা, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি নামের ক্ষতিকর সংক্রামক বীজাণুগুলো হাতের তালু বেয়ে উঠে এসেছে সর্বাঙ্গে। আজ তো এমন হয়েছে যে 'সর্ব অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা'। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। একাত্তরে মহাযজ্ঞের পবিত্র আগুনে সংক্রামক বীজাণুগুলো পুড়িয়ে ফেলার অঙ্গীকার ছিল। অঙ্গীকার ছিল মানবিক, নৈতিক, স্বার্থপরতাহীন সমাজ গড়ার। যেখানে হিংস্রতা, ধর্মান্ধতা, লোভাতুর সমাজের বদলে গড়া হবে শান্তি-সম্প্রীতির যথার্থ বাঙালি সমাজ। প্রাচীন গোঁড়ামি নয়, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনা নিয়েই সেটা গড়া হবে। গত ৪০ বছরে যেটা সম্ভব হয়নি। বরং শুভ স্বপ্নগুলো বন্দরের নোঙর ছিঁড়ে ক্রমে ভেসে গেছে লক্ষ্যহীন গন্তব্যে। শিমুল তুলার মতো আমাদের নরম স্বপ্নগুলো লক্ষ্যহীন ওড়াউড়ি করে কাঁটাঝোপে আটকে গেছে। পাকিস্তান আমলে রক্তচক্ষু শাসকের নির্মমতায় অনেক যন্ত্রণা সয়েছি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অদ্ভুত রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফলে পাকিস্তান আমলে বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়েছি। গোঁজামিল পলিসির ফলে সমাজ ও জাতীয় সংস্কৃতিতে সৃষ্টি হয়েছিল মেলা অসংগতি। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী থেকে শুরু করে সর্বস্তরে পাকিস্তানি শাসকরা গড়ে তুলেছিল ভুলের পাহাড়। এসবের বিরুদ্ধে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাঙালি প্রতিবাদ করেছে, নির্যাতিতও হয়েছে। তবু পিছু হটেনি। তাই একাত্তরেই সব বৈষম্য, নির্যাতন, শোষণ, অসংগতি চিরতরে দূর করার চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হায়! পাকিস্তানি ভূত থেকে ছাড়া পেলাম; কিন্তু ভূতের ছায়া যে রয়ে গেল তার আলামত প্রায়ই দেখতে পাই। পাকিস্তানের লিগ্যাসি যেন বয়েই বেড়াচ্ছি। সাম্প্রতিক কালের একটি ঘটনায় আমার তাই মনে হয়েছে। পাবনা জেলার বেড়া থানায় যাচ্ছিলাম শুটিংয়ের জন্য। বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে উল্লাপাড়া যেতেই গাড়ির গতি মন্থর হয়ে গেল। সামনে লম্বা গাড়ির বহর। একেবারে সামনে ও পেছনে দুটি পুলিশের গাড়ি। শুনলাম মন্ত্রী সাহেব যাচ্ছেন। উল্টোদিক থেকে কোনো গাড়ি আসতে দেওয়া হচ্ছে না। ওভারটেক করে যে এগিয়ে যাব তাতেও বাধা। অগত্যা মন্ত্রীর গাড়িবহরের পিছু পিছু পিঁপড়ের গতিতে চলতে চলতে বুঝে গেলাম সময়মতো গন্তব্যে পেঁৗছানো যাবে না। রাস্তার দুই পাশে মাঝেমধ্যেই দেখলাম স্কুলের ইউনিফর্ম পরা শিশু-কিশোরদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য। গরমে লাল হয়ে গেছে মুখ, ঘেমে চপচপ গায়ের কাপড়। আমার নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল। পাকিস্তানের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এসেছিলেন আমাদের মফস্বল শহরে। আমরা স্কুলের ক্লাস ফেলে পরিষ্কার কাপড়-চোপড় পরে বাধ্য হয়েছিলাম রাস্তার দুই পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে। রোদে পুড়ে যাচ্ছিল শরীর। ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। দু-একজন প্রচণ্ড গরমে জ্ঞানও হারিয়েছিল। আমার শিশুমনে চাপা অভিমান আর তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল সেদিন। মন্ত্রীর আগমনে রাস্তার দুই পাশে প্রচণ্ড গরম সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু-কিশোরদের দেখে ভাবলাম এক মন্ত্রীর জন্য কী করুণ দুর্দশা তাদের। তাদের শিশুমনেও কি আমার সেই শৈশবের মতো অভিমান আর ঘৃণা জন্ম নেয়নি! কী এমন দরকার ছিল ক্লাস থেকে বের করে শিশু-কিশোরদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখার? মন্ত্রীর জন্য জয়ধ্বনি না দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? মন্ত্রী যাবেন, এ জন্য সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো হবে কেন? তাও আবার গায়ের জোরে? ঘটনাটি পাকিস্তানি লিগ্যাসির কথা মনে করায়। এ রকম অনেক ব্যাপারেই ভীষণ বিব্রত বোধ করি। একরাশ হতাশা এসে ভর করে মনে। ভাবি ৪০ বছর ধরে যা চেয়েছি, তা কি ভুল করে চেয়েছি? পাশাপাশি এটা ভালো করেই বুঝি, যা পাই তা চাই না।
লেখা শেষ করি পাকিস্তান আমলের একটি ঘটনা বলে। কলেজের জনাকয়েক বন্ধু মিলে আমরা ফরিদপুর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। গোয়ালন্দের পুরনো ঘাট (যার অস্তিত্ব এখন আর নেই) থেকে ছোট ফেরিতে বিশাল পদ্মা চার-পাঁচ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে শিবালয় (আরিচা) যেতে হতো। গোয়ালন্দ থেকে ফেরি ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম বঙ্গবন্ধু যাবেন, তাই তাঁর জন্য অপেক্ষা। ফেরি ছাড়তে দেরি হচ্ছে। মুহূর্তেই সেই খবর ছড়িয়ে পড়লে ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু এলেন এবং ঘাটের মানুষের সঙ্গে সামান্য দু-চারটি কথা বলে ফেরিতে উঠলে ছেড়ে দিল। সেদিন বোধ হয় আধঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছেড়েছিল। নেতাকে ঘিরে থাকা যাত্রীদের কাছে বঙ্গবন্ধু তাঁর কারণে ফেরি ছাড়তে বিলম্ব হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই বিনয়ের ভঙ্গি বাকি জীবনে ভুলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের আচরণে সেই শিক্ষাই কী দৃষ্টান্ত হয়ে রয় না যে বড় নেতা হতে হলে বড়মাপের মানুষও হতে হয়? একালের নেতারা বঙ্গবন্ধুর জীবনচর্চা থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন, যার বেশির ভাগই কথার কথা। জয় বাংলা।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.