জন্মবিভ্রাট by জাহিরুল ইসলাম

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ না ১৬ কোটি, এ নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে জানা গেল, প্রতিবেশী ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিংকেও এক বছর আগেই অবসরে যেতে হচ্ছে জন্মতারিখ বিভ্রাটের কারণে। শুধু ভারত কেন, এ রকম ঘটনা বাংলাদেশেও আছে।


এ সংক্রান্ত তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখি, আমাদের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলাদা জন্মতারিখ ব্যবহার করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিবাহ নিবন্ধন, ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন এবং পাসপোর্টে ভিন্ন জন্মতারিখ ব্যবহারের প্রমাণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টগুলোর স্ক্যান করা কপি বল্গগে দেওয়া হয়েছে। তার জন্মতারিখ নিয়ে অতীতে বিতর্কও হয়েছে ব্যাপক।
এ তো কেবল দেশের কথা। বাংলাদেশিদের জন্মতারিখ নিয়ে বিদেশেও ব্যাপক কথা হয়। হাসাহাসিও হয়। কারণ আর কী? জন্মতারিখ বিভ্রান্তি। টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদাপূর্ণ সদস্যপদ লাভের পর থেকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করার আরেকটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আমাদের দামাল ছেলেরা তাদের অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করে বিভুঁইয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেনও। কিন্তু জন্মতারিখ নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে সে গৌরবেও কালির আঁচড় লাগার প্রমাণ আছে। শ্রীলংকার মাটিতে অভিষেক টেস্টে মোঃ আশরাফুল সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ড যখন গড়লেন, তখনও তার জন্মতারিখ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। আশরাফুলের স্কুল সার্টিফিকেট আর পাসপোর্টে উলিল্গখিত জন্মতারিখের মধ্যে নাকি মিল নেই।
সঠিক জন্মতারিখ কাগজপত্রে না ব্যবহার করাই যে এ রকম বিভ্রান্তির মূল কারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে সব দায় কি ব্যবহারকারীরই? জন্মতারিখ এমন একটি বিষয়, যার জন্য সবাইকে মা-বাবার ওপর নির্ভর করতে হয়। ব্যবহার পরের কথা, বাংলাদেশের কতজন মানুষ তার সঠিক জন্মতারিখ জানে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সন্তানের জন্মতারিখ লিখে রাখা এবং সন্তানকে তা অবগত করানোর ব্যাপারে কতজন মা-বাবা সচেতন, সে ব্যাপারেও আছে সন্দেহ।
অনেক মা-বাবা আবার ইচ্ছা করেই সন্তানের সঠিক জন্মতারিখ গোপন করেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পেছনেও রয়েছে ভিন্ন উদ্দেশ্য। প্রয়োজনের তুলনায় কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। চাকরির বয়সসীমা নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে অকারণে কর্মজীবন থেকে সে ক'বছর ঝরে পড়ে। কিন্তু সেটা কে মানতে চায়? লাভ-লোকসানের হিসাব তো রয়েছেই। তাই বুদ্ধিমান অভিভাবকরা ঝুঁকি না নিয়ে স্কুলে ভর্তির সময়ই সন্তানের বয়স কমিয়ে দেন। আবার বয়োজ্যেষ্ঠ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একইভাবে বয়স বাড়ানোরও নজির বিরল নয়।
বাংলাদেশই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে জন্মতারিখ এফিডেভিট করে সংশোধন করা যায়। বয়স কমিয়ে বেশি দিন চাকরি করা অথবা বাড়িয়ে বাড়তি সুবিধা আদায় করাও কি অনৈতিক নয়? ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নবজাতকের জন্মনিবন্ধনই এ ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। আমাদের দেশে জন্মনিবন্ধন আইন থাকলেও জনসচেতনতার অভাবে বলা চলে তা প্রায় অকার্যকর। এ আইনের সঠিক প্রয়োগ থাকলে দেশের মোট জনসংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতো না।
জন্মতারিখ বিভ্রাটের কারণে ভারতের সেনাপ্রধানকে এক বছর আগেই চাকরি ছাড়তে হচ্ছে। আমাদের সেই বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাকেও বিতর্ক হজম করতে হচ্ছে। তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। কেননা, এর দায় অনেকাংশেই তাদের মা-বাবার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদেরই। এ ধরনের পরিস্থিতি সবার জন্যই নিঃসন্দেহে বিব্রতকর। আমাদের সন্তানরাও এ ধরনের বিব্রবতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক, তা আমরা চাই কি?
zahirul.du@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.